সমালোচনা হলো আয়নায় নিজেকে দেখার সুযোগ

সত্য নাদেলা
সত্য নাদেলা

ভারতের হায়দরাবাদ পাবলিক স্কুলের ছাত্র ছিলেন সত্য নাদেলা। এখন তিনি বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন নিজের জীবনদর্শনসহ নানা বিষয় নিয়ে।

আমার বাবা মারা গেছেন গত মাসে। তিনি ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী, অর্থনীতিবিদ, সরকারি চাকুরে। জীবন সম্পর্কে তাঁর একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। মনে আছে, আমার নম্বরপত্র দেখে তিনি অবাক হয়ে বলতেন, একজন মানুষ এত খারাপ রেজাল্ট করে কী করে! তবে তিনি আমাকে খুব অনুপ্রাণিতও করেছেন। আমার মা ছিলেন একদম উল্টো। তাঁর প্রশ্ন ছিল একটাই, ‘তুমি খুশি তো?’ নম্বরপত্রের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুতেই বুঝতাম না, এখানে খুশি হওয়ার মতো কী থাকতে পারে! ভারতের হায়দরাবাদে ১৯৭০-৮০–এর দশকে আমি যে স্কুলে পড়েছি, সেটা খুব একটা পরিচিত ছিল না। মজার ব্যাপার হলো, সেই স্কুলের বেশ কয়েকজন ছাত্র এখন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে আছেন।

হায়দরাবাদ থেকে বের হব, ছোটবেলায় এটা কখনো আমার মাথায় আসেনি। ভাবতাম, আমি শুধু ক্রিকেট খেলব আর বড় হয়ে ব্যাংকে চাকরি করব। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট ভীষণ জনপ্রিয়। যেকোনো খেলাই আমাদের অনেক কিছু শেখায়, বিশেষ করে যেসব খেলা দল বেঁধে খেলতে হয়। একটা ঘটনা আমি প্রায়ই বলি। ছোটবেলায় আমাদের স্কুল ক্রিকেটে একজন অধিনায়ক ছিল। যে পরে পেশাদার ক্রিকেটেও খুব নাম করেছিল। একবার একটা ম্যাচে আমি খুব খারাপ বোলিং করছিলাম। এমন সময় অধিনায়ক নিজেই বল হাতে নিল, দারুণ একটা ওভার করে আমাদের ব্রেক থ্রু এনে দিল। তারপর আবার বল দিল আমার হাতে। পরের ওভারেই আমি সম্ভবত আমার জীবনের সেরা ৬টা বল করেছিলাম। তখন খুব অবাক লেগেছিল, কেন সে আবার আমাকে বল করতে দিয়েছিল! এখন বুঝি। আমার আত্মবিশ্বাস ভেঙে না দেওয়ার গুরুত্বটা সে বুঝেছিল। হাইস্কুল ক্রিকেটের একজন অধিনায়কের এই অনবদ্য নেতৃত্বগুণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। দলীয় খেলা এভাবেই আমাদের শেখায়। 

আমার জীবনদর্শনের একটা বড় অংশজুড়ে আছে সমানুভূতি। আমি আর আমার স্ত্রী একই সঙ্গে বড় হয়েছি। আমরা এক স্কুলে পড়তাম। আমাদের প্রথম সন্তান জন্মানোর আগে দুজনই ভীষণ রোমাঞ্চিত ছিলাম। আমার স্ত্রী একজন স্থপতি। আমরা নানা রকম পরিকল্পনা করছিলাম। যেহেতু দুজনই কাজ করি, সন্তানকে কীভাবে মানুষ করব, ওকে কোন ডে কেয়ার সেন্টারে রাখব...ইত্যাদি নিয়ে আমরা ভাবছিলাম। কিন্তু ছেলেটা জন্ম নেওয়ার পর কিছু জটিলতা তৈরি হলো। জন্ম থেকেই সে একটা কঠিন অসুখে আক্রান্ত। ওর বয়স পাঁচ হওয়া পর্যন্ত আমি আর আমার স্ত্রী দুজনই ওকে বাঁচিয়ে রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করেছি। প্রাথমিকভাবে নিজেদের জীবন নিয়ে যা কিছু পরিকল্পনা করেছিলাম, হঠাৎই সব বদলে গেল। আমার স্ত্রী অনু আমাদের সন্তানকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। যত রকম চিকিৎসা সম্ভব, যত থেরাপি দেওয়া সম্ভব, সব চেষ্টাই সে করেছে। আমি শুধু দেখছিলাম আর মনে হচ্ছিল আমার জীবনটাই কেন এমন দুর্বিষহ হলো। 

সে সময়ই হঠাৎ একটা বোধোদয় হলো। আমার তো আসলে কিছু হয়নি, হয়েছে আমার সন্তানের। আমার উচিত ছিল আমার সন্তানের চোখে পৃথিবীটাকে দেখা এবং বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্বটা পালন করা। এটাই তো সমানুভূতি। জন্মগতভাবেই আমাদের সবার মধ্যে সমানুভূতির বৈশিষ্ট্য থাকে। জীবন ছোট-বড় নানা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের সমানুভূতি শেখায়। 

আমি যখন মাইক্রোসফটে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছি, বেশ কয়েকটা ধাপ পেরোতে হয়েছে। শেষ ধাপে আমার ইন্টারভিউ যিনি নিয়েছিলেন, তাঁর একটা প্রশ্ন আমার জীবন বদলে দিয়েছে। সেই প্রশ্নটিও সমানুভূতি–সংক্রান্ত। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ধরো তুমি একটা রাস্তা পার হচ্ছ। হঠাৎ দেখলে, একটা ছোট বাচ্চা রাস্তায় পড়ে গেছে। তুমি কী করবে?’ মনে মনে ভাবলাম, ‘যাহ! এই সার্চ অ্যালগরিদম তো আমি শিখিনি! এটা নিশ্চয়ই খুব জটিল কোনো প্রশ্ন!’ আমি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলাম। তারপর বললাম, ‘আমি ফোন বুথে গিয়ে ৯১১ ডায়াল করব।’ বলছি স্মার্টফোন যুগের আগের কথা। 

প্রশ্নকর্তা উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘তোমার নিজের মধ্যে কিছুটা সমানুভূতি গড়ে তোলা উচিত। কারণ, একটা বাচ্চা যখন পড়ে যায়, তোমার প্রথম কাজ হলো তাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরা। তারপর নাহয় ফোন করো।’ মনে মনে ভেবেছিলাম, চাকরিটা বুঝি আর হলো না। যাহোক, দেখতেই পাচ্ছেন, চাকরিটা আমি পেয়েছিলাম। সত্যি বলতে, তখন সমানুভূতি নিয়ে খুব একটা ভাবতাম না। আমার মনে হয়েছিল, ব্যবসার সঙ্গে, কাজের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? এখন আমি বুঝতে পারি। আপনি যখন নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন, আপনাকে তো কাস্টমারের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। বুঝতে হবে, তাঁর কী প্রয়োজন। আমার কাছে এটাই সমানুভূতি। তাই আমি বিশ্বাস করি, জীবন মানুষকে সমানুভূতি শেখায় আর সফল হতে হলে সমানুভূতি খুব দরকার।

আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এটি কীভাবে গড়ে তোলা যায়, মাইক্রোসফটে আমরা ইদানীং ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবছি। যেমন ধরুন, সমানুভূতির শুরু হয় শ্রদ্ধা থেকে। আপনি যখন একজন মানুষকে শ্রদ্ধা করবেন, জানবেন তিনি কোথা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অংশে কাজ করেই আমি শিখেছি, কীভাবে একটা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হয়। অনেকে বলে, ‘স্টিভ যখন তোমাকে মাইক্রোসফট ক্লাউডের দায়িত্ব দিল, তখন কী ভেবেছিলে তুমি সিইও হতে যাচ্ছ।’ সত্যি বলতে, একেবারেই না। এটা আমার ধারণাতেই ছিল না। 

ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমার উপদেশ, পরের সুযোগটার অপেক্ষায় থেকো না। ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়। ভাবে, আমি কবে সিইও হব। আমি বলব, তোমার সেরাটা দেওয়ার জন্য পরবর্তী চাকরির অপেক্ষা কোরো না। এখন যেখানে আছ, সেখানেই নিজের পুরোটা ঢেলে দাও। তুমি যখন যে কাজটা করছ, ধরে নাও এটাই তোমার শেষ কাজ এবং এটাই তোমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

আমি মনে করি, ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানেই দারুণ সব সুযোগ আছে। কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সময় আমি সব সময় বলি, তুমি যদি নিজে ‘কুল’ হতে চাও, তাহলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দাও। আর যদি মানুষকে ‘কুল’ বানাতে চাও, তাহলে মাইক্রোসফটে যোগ দাও। এ কথা বলি কারণ, আমি বিশ্বাস করি, বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একটা বড় দায়িত্বও। বিজনেস স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই হয়তো তুমি অনেক কিছু শিখে এসেছ, এখানে এসেও শিখবে। কিন্তু সবটাই নির্ভর করে তোমার দলটা কেমন, তার ওপর। ছোট-বড় যেমন প্রতিষ্ঠানেই তুমি কাজ করো না কেন, এক দল লোকের সঙ্গে তোমাকে কাজ করতেই হবে।  

মাইক্রোসফটকে অনেক সমালোচনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমি বলব, সমালোচনার সময়টাই আয়নার দিকে তাকানোর সুযোগ। যখন তোমাকে নিয়ে সমালোচনা হবে, তখন তুমি আয়নায় নিজেকে দেখো এবং ভাবো, কেন তুমি সমালোচিত হচ্ছ। হতে পারে তোমার কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। আমি মনে করি, সমালোচনাকে স্বাগত জানানো উচিত। কারণ, সমালোচনা থেকে শেখার আছে। 

আমি সব সময় বলি, যখন মানুষ তোমার সাফল্য উদ্​যাপন করতে শুরু করবে, তখনই সবচেয়ে ভীত হও।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও