মেয়ে তুমি কোথায় নিরাপদ?

সেদিন বিকেলে ছোট্ট সায়মা মাকে বলে খেলতে গিয়েছিল। দূরে কোথাও নয়। যে বাড়িতে সে থাকে, সেই বাড়িরই একটি ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়েছিল সে। সন্ধ্যা হওয়ার পরও বাড়ি না ফেরায় মায়ের শঙ্কা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পরই খুঁজে পাওয়া যায় ছোট্ট দেহটি, প্রাণহীন। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় তাকে । ঘটনাটি ঘটে গত জুলাইয়ে রাজধানীর ওয়ারীতে। এরপরও অনেক ধর্ষণের ঘটনার কথা আমরা জানতে পেরেছি। বীভৎসতায় যেন কোনোটা কোনোটার চেয়ে কম নয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও ধর্ষণের হার কমায় খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর তুলনায় নারীদের অবস্থান বেশি নাজুক। পুরুষের তুলনায় নারীরা পাঁচ গুণ বেশি ধর্ষণের শিকার হন। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো বেশির ভাগ সময় পরিচিত বা খুব কাছের মানুষের দ্বারাই ধর্ষণের শিক্ষার হন নারী।

বিশ্লেষকেরা বলেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব, মাদকের বিস্তার, বিচারহীনতা, বিচার–প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। ধর্ষণ করলে অপরাধীর কোনো শাস্তি হবে না, এই মনোভাবের কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে। মার্কিন মনোবিদ নিকোলাস গ্রোথের মতে, সব ধর্ষকের মধ্যে তিনটি আকাঙ্ক্ষার অন্তত একটি উপস্থিত থাকে। সেগুলো হলো দুঃখবাদ, ক্রোধ বা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর ক্ষমতা দেখানো, তাকে দখল করার মনোবৃত্তি এবং অবদমিত কাম চরিতার্থ করতে ধর্ষণ করেন ধর্ষক।

জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন ও গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের চলতি বছরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৩৫ শতাংশ নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময় খুব কাছের মানুষের দ্বারা এই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের চলতি বছরের তথ্য অনুযায়ী, ধর্ষণের শিকার ৪০ শতাংশ নারী নির্যাতিত হয়েও চুপ থাকেন। ১০ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেন।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি
পরিসংখ্যান বলছে (ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ), বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখে ১০ জন ধর্ষণের শিকার হন। ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এরপরই রয়েছে শিশুরা। অর্থাৎ অল্প বয়সী মেয়েরা, যাদের প্রতিরোধের শক্তি-সাহস নেই, তারাই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৭৮৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯টি শিশুকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ১১০টি শিশুকে। বিভিন্নভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৭৯টি শিশু। এসব শিশুই যে মেয়ে তা নয়, ছেলেশিশুরাও নির্যাতনের শিকার হয়। শিশু অধিকার ফোরাম এই হিসাব দিয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে। বাস্তবে শিশুদের যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানা কারণে প্রকাশই হয় না। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৫২১টি শিশু, ২০১৬ সালে ৪৪৬টি শিশু, ২০১৭ সালে ৫৯৩টি শিশু এবং ২০১৮ সালে ৫৪১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ ছাড়া যৌন নিপীড়নের আরও যে বিষয়গুলো আছে, তা-ও বাড়ছে। এসব নির্যাতনের মধ্যে মানসিক ও শারীরিক নানা ধরনের নির্যাতন রয়েছে।

যৌন নির্যাতন কাকে বলে?
২০০৯ সালে যৌন হয়রানি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করে রায় দেন হাইকোর্ট। সে সংজ্ঞা অনুযায়ী, অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি বা ইঙ্গিতে), পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পেছন পেছন যাওয়া এবং যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা হলেও তা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়বে। এমনকি চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ ও বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা, ব্ল্যাকমেল অথবা চরিত্র স্খলনের উদ্দেশ্যে স্থির বা চলমান চিত্র ধারণ করা, যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া, প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা এবং ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনে চেষ্টা করা হলেও তা যৌন হয়রানি হবে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি চারটি মেয়েশিশুর মধ্যে একজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর প্রতি ছয়টি ছেলেশিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় একজন। কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের শিশু যৌন নির্যাতনের হার অনেক বেশি।

বিশ্ব পরিস্থিতি
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের নারীদের ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীর চেয়ে তাঁরা চার গুণ বেশি নাজুক অবস্থায় আছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংগঠিত শিশু যৌন হয়রানির পরিসংখ্যান ঘেঁটে গত বছর একটি তালিকা তৈরি করেছে ব্রিটেনের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস। তারা বলছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতি তিন মিনিটে একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। দেশটির মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের ২০০৯ সালে করা একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতি চারজন পুরুষের একজন জীবনের কোনো একসময়ে কাউকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬৭ হাজার শিশু ধর্ষণ এবং নিগ্রহের মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল। এরপরই আছে ভারত। দ্য এশিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস ২০১৩ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন মহামারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশটিতে ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে শিশু ধর্ষণের অন্তত ৪৮ হাজার মামলা হয়েছে৷

আসলে সারা বিশ্বেই নারীর ওপর সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটিতে প্রতি ১ লাখের মধ্যে ১৩২ জনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হন। বতসোয়ানায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। দেশটির প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে ৯৩ জন ধর্ষণের শিকার হন। লেসোথোয় ২০১৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার ১ লাখ নারীর মধ্যে ৮৩ জন ধর্ষণের শিকার হন। ১১৮টি দেশের মধ্যে চালানো এই জরিপে ১৪তম অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি শান্তির দেশ নরওয়েতেও প্রতি লাখে ১৯ জনের বেশি মানুষ ধর্ষণের শিকার হন।