যেকোনো সময় হাজির 'সুলতানা আপা'

নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতার কাজ করেন সুলতানা বেগম। সম্প্রতি মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সিকদারপাড়া এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতার কাজ করেন সুলতানা বেগম। সম্প্রতি মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সিকদারপাড়া এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

১২ নভেম্বর দিবাগত রাত প্রায় তিনটা। কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের নাসির মোহাম্মদ ডেইল গ্রামের গৃহবধূ তাসনিম বেগমের (২০) হঠাৎ প্রসববেদনা ওঠে। এত রাতে দুর্গম উপকূলে চিকিৎসক পাওয়া মুশকিল। ইউনিয়নের কোথাও নেই হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকও। গৃহবধূর প্রসবযন্ত্রণা, চিৎকার কারও সহ্য হচ্ছিল না।

তাসনিমকে তোলা হলো একটি ব্যাটারিচালিত টমটমে। টমটম ছুটছে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে পাশের ইউনিয়ন মাতারবাড়ীর উদ্দেশে—ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে। টমটমে বসে গৃহবধূর স্বজনেরা বলাবলি করছিলেন, এত রাতে কেন্দ্র খোলা থাকবে তো! যদি খোলা না থাকে, তাহলে উপায়?

ভোর চারটার দিকে কেন্দ্রের সামনে পৌঁছায় টমটম। রোগীর চিৎকার শুনে কেন্দ্র থেকে এক নারী দৌড়ে এলেন টমটমের কাছে। নাম তাঁর সুলতানা বেগম (৪৮)। তিনি ওই কেন্দ্রের পরিবারকল্যাণ সহকারী। গ্রামের মানুষ তাঁকে চেনেন ‘সুলতানা আপা’ নামে। মুহূর্তে গৃহবধূকে নেওয়া হলো কেন্দ্রের ভেতরে। শুরু হলো প্রসূতিসেবা। পরদিন ১৩ নভেম্বর সকাল আটটায় তাসনিমের কোল আলোকিত করল ফুটফুটে ছেলেসন্তান। নবজাতকের দিকে একনজর দেখে মায়ের মুখে হাসি। পরিবারের সবার আনন্দ।

১৩ নভেম্বর সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কয়েক দফায় মাতারবাড়ী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে অবস্থান করে দেখা গেল, সুলতানা বেগম রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। মোহাম্মদ সেলিম নামের একজন এসেছেন তাঁর স্ত্রীর প্রসবকালীন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। আরও কয়েকজন নারী এসেছেন পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ, গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রসূতিসেবার পরামর্শ নিতে। ওই দিন এ কেন্দ্রে জন্ম হয় তিনটি শিশুর।

তাসনিম বেগমের স্বামী মির কাসেম (২৮) বললেন, আল্লাহর অশেষ কৃপায় প্রথম সন্তানের বাবা হলাম। ভরসা ছিলেন সুলতানা আপা। মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার রাস্তাঘাট খুব খারাপ। নইলে ৭০-১০০ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া কিংবা কক্সবাজার শহরের হাসপাতালে নিয়ে সন্তান প্রসব করানো কঠিন ছিল। খরচও হতো ১৫-২০ হাজার টাকা। সেই টাকাও হাতে ছিল না।

১২ নভেম্বর দুপুরে এই কেন্দ্রে সন্তানের জন্ম দেন স্থানীয় রাজঘাট এলাকার জেলে আবদুল মজিদের স্ত্রী। আবদুল মজিদ বললেন, এতে তাঁর কোনো টাকাপয়সা খরচ হয়নি। যদিও এর আগে তাঁর দুই সন্তানের জন্ম হয়েছিল চকরিয়ার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে, খরচ হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা করে।

কেন্দ্রের রেজিস্টার খাতা ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী এ পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে এসে প্রসবসেবা নিচ্ছেন। গত পাঁচ বছরে এ কেন্দ্রে সন্তান জন্ম দিয়েছেন ২ হাজার ১৪৭ জন নারী। ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয় এ কেন্দ্র। কেন্দ্র থেকে সুলতানার বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। ফোন পেলেই রাত-দিন যেকোনো সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজির হন তিনি।

স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্র জানায়, সুলতানা বেগমের কাজের মধ্যে রয়েছে, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রসব, মাঠপর্যায়ে গিয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিতরণ ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকাদান।

মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, নারীর স্বাস্থ্যসেবায় সুলতানা বেগম সবার আস্থা অর্জন করেছেন। এ কারণে পাশের উপজেলা থেকেও রোগীরা সুলতানার কাছে ছুটে আসছে। কেন্দ্রে রোগী কমে গেলে সুলতানা নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজখবর নেন রোগীদের।

সুলতানার কথা
সুলতানা বেগমের বাড়ি মাতারবাড়ীর সিকদারপাড়ায়। স্বামী কহিনুর হোছাইন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মা সুলতানা পরিবারকল্যাণ সহকারী হিসেবে যোগ দেন ১৯৯২ সালের ২ জুলাই। ২০০৫ সালে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল এবং মা ও শিশু হাসপাতাল থেকে দক্ষ ধাত্রী প্রসূতিসেবার (কমিউনিটি স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্ট বা সিএসবিএ) ওপর ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল থেকে একই বিষয়ে আরও তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তারপর নেমে পড়েন মাঠে। পরম মমতায় প্রসূতিসেবা দিয়ে জয় করেন অসংখ্য মানুষের মন।

প্রসূতিসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৭ সালে সারা দেশে শ্রেষ্ঠ পরিবারকল্যাণ সহকারী নির্বাচিত হন সুলতানা। একই বছরের ২৮ নভেম্বর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে এ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়। ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা ১৪ বার তিনি জেলা ও উপজেলায় শ্রেষ্ঠ পরিবারকল্যাণ সহকারীর পুরস্কার লাভ করেন। চলতি বছরের ১১ জুলাই তিনি উপজেলার শ্রেষ্ঠ পরিবারকল্যাণ সহকারী নির্বাচিত হন।

সুলতানা বেগম বলেন, মাতারবাড়ী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ধলঘাট, শাপলাপুর, কালারমারছড়া ও পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের নারীরা এ কেন্দ্রে এসে প্রসূতিসেবা নিচ্ছেন। কিন্তু জটিল প্রসবসেবার জন্য এ কেন্দ্রে একজন গাইনি চিকিৎসক দরকার। কারণ, দুর্গম উপকূল থেকে রাতের বেলায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের দূরের হাসপাতালে পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ।

সুলতানা বেগম এ প্রতিবেদককে তাঁর পরিবারের একটি ঘটনা শোনান। ১৯৮৫ সালে তাঁর ভাবির হঠাৎ প্রসববেদনা ওঠে। যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন তিনি। কিন্তু আশপাশে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল না। হাসপাতাল ছিল ৩৫ কিলোমিটার দূরে। তখন স্কুলের ছাত্রী সুলতানা প্রতিজ্ঞা করেন, ডাক্তার যদি না হতে পারেন, অন্তত একজন স্বাস্থ্যকর্মী হয়ে অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়াবেন। সুলতানা বলেন, উপকূলীয় নারীদের সেবা দিতে পেরে তিনি খুশি।

যে কারণে পুরস্কার
মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক অছিউর রহমান বলেন, ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতিসেবা চালু হয়। প্রথম দিকে এখানে প্রতি মাসে ৩০ জন প্রসূতি সন্তান প্রসব করতেন। এখন তা ৫০ থেকে ৬০ জন। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কেন্দ্রমুখী করার অন্যতম উদ্যোক্তা সুলতানা বেগম।
কক্সবাজার জেলার ৮টি উপজেলার ৪৯টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে প্রসূতিসেবা চালু আছে ৪৫ টিতে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের কার্যক্রম তদারক করা হয়।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য্য বললেন, প্রসূতিসেবা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা, উঠান বৈঠক, নারীদের টিকা দেওয়া—সব কটি কাজের বার্ষিক লক্ষ্য পুরণ করতে পারেন সুলতানা বেগম। এ কারণেই পরিবারকল্যাণ সহকারী হিসেবে স্বীকৃতি পান তিনি।