অনেকে আমাকে উন্মাদ ভাবত

জেসিকা অ্যালবা
জেসিকা অ্যালবা
>হলিউড অভিনেত্রী জেসিকা অ্যালবা এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। ২০১২ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান দ্য অনেস্ট কোম্পানি ১০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। মাত্র তিন বছরে সেই প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয় ৩০০ জনের। অভিনব ব্যবসায়িক কৌশল ও উদ্ভাবনী চিন্তার কারণে এই অভিনেত্রী ফোর্বস সাময়িকীর প্রচ্ছদে ‘আমেরিকাস রিচেস্ট সেলফ-মেড উইমেন’ হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। ২০১৫ সালে ফোর্বস আয়োজিত ‘উইমেন সামিট’-এর একটি আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের কিছু অংশ থাকল আজ।

২০০৭ সালে আমি যখন প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছি, এক বন্ধু আমার অনাগত সন্তানের জন্য কিছু পোশাক উপহার দেন। সেগুলো বাড়ি এনে ধুয়ে রাখার জন্য আমি আমার মায়ের পরামর্শে কেনা একটা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করি। মা বলেছিল, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন সে-ও নবজাতকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি এই ডিটারজেন্ট ব্যবহার করেছে। কিন্তু এটি ব্যবহারের পর আমার গায়ে মারাত্মক রকমের র‌্যাশ হয়, হাঁচি দিতে শুরু করি। দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। আমার ওপরই যদি এই ডিটারজেন্টের এমন প্রতিক্রিয়া হয়, আমার নবজাতকের ওপর না জানি কী হবে! আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই ডিটারজেন্টে ব্যবহৃত কেমিক্যালগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নিতে শুরু করি।

একসময় জানতে পারি, ১৯৮১ সালের দিকে যেই পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান এই ডিটারজেন্টে ব্যবহৃত হতো, সময়ের ব্যবধানে তাতে রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা আরও বেড়েছে। এরপর আমি পড়তে শুরু করি নবজাতকের সুরক্ষায় ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র যেমন ডায়াপার, ওয়াইপসে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপকরণ নিয়ে। যত পড়তে থাকি, আমার দুশ্চিন্তা তত বাড়ে। নবজাতকের পরিচর্যার জন্য এমন নির্ভরযোগ্য পণ্যের অভাব বোধ করতে শুরু করি, যাতে কোনো রাসায়নিক পদার্থ নেই। আমার প্রতিষ্ঠানের প্রথম ধাপ ছিল সেটা।

যেভাবে শুরু

প্রথম সন্তানের জন্মের পর প্রাথমিকভাবে দ্য অনেস্ট কোম্পানি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। শুরুর দিকে সবাই বিষয়টাকে হালকাভাবে নিত। নিজের ভাবনা সবার সামনে প্রতিষ্ঠিত করতেই অনেকটা সময় চলে যায়। ছেলেবেলায় অ্যাজমা ও অ্যালার্জির কারণে খুব ভুগেছি। তাই কোনোভাবেই চাইনি, আমার সন্তানেরাও আমার মতো অসুখ-বিসুখে ভুগুক। তাই নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ একটা ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা আমার জন্য খুব জরুরি ছিল।

আমার মা মাত্র ২৩ বছর বয়সে সার্ভিকাল ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। নানি পাকস্থলীর ক্যানসারে ভুগে মারা গেছেন। অনেক বন্ধুকে দেখি, সন্তানধারণ করতে পারছে না। ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের কারণেই এসব রোগ হচ্ছে। মেঝের কার্পেট থেকে শুরু করে চুলের শ্যাম্পু পর্যন্ত সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিকর। তখন আমি আমার ভাবনাগুলো নিয়ে ৫০ পৃষ্ঠার একটা পরিকল্পনা সাজাই। সেখানে দেয়ালের রং থেকে শুরু করে বাচ্চার ডায়াপার, মেকআপ—সবকিছুই কোনো বিষাক্ত পদার্থ ছাড়া কেমন করে বানাতে পারি আর বাজারজাত করতে পারি, সেসব উল্লেখ করি।

বাধা পেরিয়ে

শুরুতে আমার পরিকল্পনা দেখে অনেকে আমাকে উন্মাদ ভাবত। পরামর্শ দিত, ‘এতগুলো পণ্য নিয়ে না ভেবে তুমি একটি পণ্যের দিকেই মনোযোগ দাও। একদিক নিয়ে ভাবো, একটা জিনিসই তৈরি করো, বাজারজাত করো। ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হলে এরপর আস্তে আস্তে নিজের পরিধি বাড়াও।’ কিন্তু আমার কথা ছিল, ‘না, আমি ধীরে ধীরে এগোতে চাই না।’ একজন মা যেমন এক হাতে সন্তান সামলান, ঘরের খেয়াল রাখেন, রান্না করেন, কেনাকাটা করেন, পরিবারের সবার জন্য ভাবেন; আমিও তেমন একই সঙ্গে সবকিছু নিয়ে এগোতে চাই। তাই আমি মোট ১৭টা পণ্য নিয়ে আমার ব্র্যান্ড চালু করি।

শুরুতে প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান লি আমার পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। যখন তাঁর কাছে ৫০ পৃষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন এটা অবাস্তব চিন্তা। আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮ মাস পর তিনি যখন তাঁর প্রথম সন্তানের বাবা হলেন, তখন বুঝতে পারলেন, রাসায়নিক পদার্থমুক্ত পণ্যের প্রয়োজনীয়তা কত বেশি। এরপরই ব্রায়ান যোগ দিলেন আমার সঙ্গে। আমরা তখন ৫০ পৃষ্ঠার সেই পরিকল্পনাকে ১০ পৃষ্ঠার প্রেজেন্টেশন বানালাম। মানুষ অবশ্য তখনো আমার পরিকল্পনায় আস্থা রাখতে পারছিল না। আমি টানা তিন বছর অনেকের অবিশ্বাস আর অনাস্থায় ভরা চেহারা দেখেছি। কিন্তু আমার বার্তা পরিষ্কার ছিল—আমি প্রতিটি সন্তান ও মায়েদের জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত, সাশ্রয়ী ও রাসায়নিকমুক্ত দৈনন্দিন পণ্য তৈরি করতে চেয়েছি।

মানুষ যত বেশি আমাকে নিরুৎসাহিত করেছে, তত বেশি এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ পেয়েছি। আমি চাইছিলাম, সবাই আমার উদ্যোগ নিয়ে অবিশ্বাস দেখাক, বাঁকা চোখে দেখুক। সেটাই হয়েছে। আর এ কারণেই চলার পথে আমি আমার উদ্যোগের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে স্পষ্ট থাকতে পেরেছি। সবার অবিশ্বাস আর বিস্ময়ের জবাব দিতে পেরেছি।

মজার বিষয় হলো, আমরা অনেক সময় নিজেদের ধারণা আর অনুমানকে আমলে নিই না। অনেক উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা সবাই আমাকে বলেন আর আমি নিজেও মনে করি, নিজের বিশ্বাস আর অনুমানকে প্রাধান্য দেওয়াই হলো একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় গুণ। সফল উদ্যোক্তারা যেকোনো ধরনের প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতায় নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে লেগে থাকেন, তাঁরা তাঁদের গন্তব্যের ব্যাপারে স্পষ্ট আর দৃঢ় থাকেন। তাই কারও কোনো প্রশ্ন, কোনো অবিশ্বাস আমাকে দমাতে পারেনি। নিজের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত আমাকে প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হয়েছে। লোকে বলত, এত পরিশ্রম না করে তুমি ভালো ভালো পণ্যের প্রচার করলেই পারো, বা পারফিউমের ব্র্যান্ড চালু করতে পারো। কিন্তু আমি আমার লক্ষ্যে অটুট ছিলাম।

জেসিকা অ্যালবা
জেসিকা অ্যালবা

ভুল থেকে শেখা

ব্র্যান্ডটা চালু করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন ধাপ। শুরুর দিকে অনেকবার আমাকে থেমে থেমে কাজ করতে হয়েছে। আমরা ভুল করেছি, আবার শুধরে নিয়েছি। যেমন পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইট চালুর পাঁচ সপ্তাহ পর দেখলাম, আমরা কোনো ক্রেতার ক্রেডিট কার্ডের তথ্য রাখছি না। তখন নিবন্ধন করা সব ক্রেতাকে ফোন করে করে তাঁদের তথ্য জোগাড় করতে হয়েছে। এভাবে ভুল করে করে শিখেছি। আমি মনে করি, ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিটা ধাপ এগোনো মানে হলো আরও ১০০টা প্রতিবন্ধকতার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। চ্যালেঞ্জ কখনো শেষ হওয়ার নয়। আমরা যত এগোব; প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা ততই বাড়তে থাকবে। সবকিছুর সমাধান করতে করতেই আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

উদ্যোক্তা হওয়ার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি যে শিক্ষাগুলো পেয়েছি, সেগুলো হলো—কারও কাছে সাহায্য চাইতে দ্বিধা করা যাবে না। যাকেই ব্যবসার জন্য দরকারি মনে হবে, তার কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। সমালোচনাকে ভয় করলে চলবে না। এবং যদি কোনো বিষয় আমি না জানি, তাহলে সেটা প্রকাশ করতে হবে। আমাকে সব সময় সবকিছু জানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সব পরিস্থিতি থেকে, সব ধরনের মানুষের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটা ভুল একজন মানুষকে থামিয়ে দেয় না। এটা বরং একজনকে চলতে সাহায্য করে।

খুব অল্প বয়সে আমি অভিনয় করতে আসি। সত্যি বলতে, তখন থেকে শুধু অর্থের পেছনে ছুটেছি। সব সময় উপলব্ধি করতাম, আমাকে উপলব্ধি করানো হতো যে নায়িকাদের ক্যারিয়ার হয় অল্প সময়ের। তাই আমি অল্প সময়ে যত পেরেছি কাজ করেছি, আয় করেছি, সঞ্চয় করেছি। কারণ, ছোটবেলায় দেখতাম আমার মা-বাবা আর্থিক সচ্ছলতার জন্য একসঙ্গে তিনটা চাকরি করতেন। তাঁরা অনেক কষ্ট করেছেন সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্য। আমি তাঁদের মতো জীবন চাইনি। তাই একটা পর্যায় পর্যন্ত আর্থিক বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতাম। জানতাম, নায়িকা হিসেবে আজ যে কাজ পাচ্ছি, এটা শিগগিরই হারিয়ে যাবে। তাই কখনো কোনো বিরতি নিইনি। আমাকে নিয়ে কে কী ভাবত, এসব মাথায় আনার সুযোগই ছিল না।

নায়িকা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার সময় এ কারণেই একটা সুবিধা পেয়েছি। শুরু থেকেই জানতাম, ব্যবসার জগতে অনেকে আমাকে ভালোভাবে নেবে না। তাই আমাকে নিয়ে কে কী ভাবল, সেসব আমি পাত্তাও দিতাম না। আমি প্রত্যাখ্যানে অভ্যস্ত ছিলাম। অভিনয়ের জগতে নানা সময় নানাভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। তাই নিজের ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করার সময়ও আমি প্রত্যাখ্যানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কারও কাছে ব্র্যান্ডের পরিকল্পনা নিয়ে গেলে তাঁরা আমাকে বড় পর্দার অল্প পোশাক পরা একজন নায়িকা ভাবতেন। ভাবতেন ব্যবসা নিয়ে আমার হয়তো কোনো জ্ঞান নেই। আমিও যে ভাবতে পারি, আমার যে নিজস্ব পরিকল্পনা আর দূরদর্শিতা থাকতে পারে, এটা মানতে চাইত না অনেকে। কিন্তু আমি সবাইকে মানিয়েই ছেড়েছি। আমার চামড়া মোটা ছিল। নিন্দুকের নিন্দা তাই গায়ে লাগাইনি। আমি আমার মতো কাজ করে গেছি, আমার ব্র্যান্ড পৌঁছে দিয়েছি ঘরে ঘরে, তাই এখন আমার গ্রাহকেরাই কথা বলে আমার হয়ে। নিজের ব্র্যান্ডকে প্রতিষ্ঠার জন্য আমাকে তারকাখ্যাতি কিংবা পণ্যের মোড়কে নিজের ছবি বসাতে হয়নি।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান
সূত্র: ফোর্বস সাময়িকী