অসহায় মানুষের হাসিই তাঁর জীবনের সুখ

আইনজীবী তুতুল বাহার।  ছবি: জুয়েল শীল
আইনজীবী তুতুল বাহার। ছবি: জুয়েল শীল

ঘটনাটি ২০০৩ সালের। পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে অভিভাবকহারা হয় দুই বছর বয়সী এক ছেলে শিশু। স্থান হয় সরকারি শিশু পরিবারে (সেফ হোম)। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও মেলেনি অভিভাবকের সন্ধান। একপর্যায়ে শিশুটির জন্য মমতার হাত বাড়িয়ে দেন আইনজীবী তুতুল বাহার। আদালতের মাধ্যমে জিম্মা নিয়ে তাকে লালন-পালন করছেন। সেই ছেলেটি এখন পড়ছে দশম শ্রেণিতে।

 সেফ হোমে বড় হওয়া ১৯ বছরের আরেক তরুণীর দায়িত্বও নিয়েছেন তুতুল। ওই তরুণী ৪ বছর বয়সে হারিয়ে যান। গত ২২ জুলাই আদালতের মাধ্যমে তাঁকে জিম্মায় নেন তুতুল বাহার। পরে তাঁকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তৈরি পোশাক কারখানায়।

শুধু এ দুজনই নয়, ২২ বছরের আইনি পেশায় শতাধিক অভিভাবকহীন নারী-শিশুকে জিম্মায় নিয়ে নিজের বাসায় রেখেছেন তুতুল বাহার। বিয়ে দিয়েছেন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আর অসহায় মানুষের পক্ষে বিনা মূলে৵ মামলা লড়েছেন ২০ হাজারের বেশি।

চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে অসহায়দের সহায় শব্দটির পরই তুতুল বাহারের নামটি যোগ হয়েছে।  তুতুল বাহার বললেন, ‘মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা থাকে সব সময়।’

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আইয়ুব খান চট্টগ্রামের ‘মাদার তেরেসা’ হিসেবেই আখ্যায়িত করলেন তুতুল বাহারকে। বললেন, ‘নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন থেকে। আমাদের আরও অনেক তুতুল বাহার প্রয়োজন।’

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ বাদুড়তলা এলাকার তুতুল ১৯৯৫ সালে আইন পেশায় যুক্ত হন। এরপর কারাগারে গিয়ে খোঁজ নিতে থাকেন অসহায় নারীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য। বিনা মূলে৵ সরকারি আইনি সহায়তা তখন ব্যাপক আকারে ছিল না। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়। 

কারা সূত্র জানায়, পারিবারিক বিরোধের মামলায় ১৪ বছর কারাগারে থাকা সাতকানিয়ার মনু মিয়ার পক্ষে মামলা লড়েন তুতুল বাহার। ১৯৯৫ সালে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন। পরে  এই মামলা থেকে খালাস পান মনু মিয়া। পরের বছর চট্টগ্রামের এক নির্বাচনী কর্মকর্তার ধর্ষণের ঘটনায় তাঁর বাসার এক গৃহকর্মীর ছেলেসন্তান হয়। তার পাশে দাঁড়ান তুতুল বাহার। ৫ বছর মামলা লড়ার পর চাপে পড়ে ধর্ষণের শিকার ওই নারী আপস করেন। এরপর তিনি লেবানন যান, ২০১১ সালে দেশে ফিরে আসেন। এখন নগরের বগারবিল এলাকায় থাকেন। ওই নারী বললেন, ‘তাঁর ছেলেটি বড় হয়ে এখন চাকরি করছে। সেই দিন আপা (তুতুল বাহার) না থাকলে মা-ছেলে দুজনই হয়তো এত দিন বেঁচে থাকতে পারতাম না।’

নারীদের সঙ্গে কথা বলছেন আইনজীবী তুতুল বাহার। ছবি: জুয়েল শীল
নারীদের সঙ্গে কথা বলছেন আইনজীবী তুতুল বাহার। ছবি: জুয়েল শীল

খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, বাঁশখালী ও রাঙামাটির চার নারী ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে চট্টগ্রামে আসেন। কিন্তু তাঁদের বিক্রি করা হয় যৌনপল্লিতে। সেখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করলে জায়গা হয় কারাগার থেকে সেফ হোমে। কেউ ২ বছর, কেউ ৫ বছর থাকলেও কোনো অভিভাবক না থাকায় আদালত জিম্মায় দিতে পারেননি। ২০০৫ থেকে ২০০৬ সালের মধে৵ তাঁদের জিম্মায় নেন তুতুল বাহার। এরপর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের মা-বাবার হাতে তুলে দেন তিনি। একজন এখন পোশাক কারখানায় কাজ করছেন।

 নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এর সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম বললেন, তাঁর (তুতুলের) কার্যক্রমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আদালত অভিভাবকহীন নারী ও শিশুদের তাঁর জিম্মায় দিচ্ছেন।

 বাকপ্রতিবন্ধী মৌসুমী আক্তার। ২০০৫ সালে ফেনীর একটি মামলায় চট্টগ্রামে রউফাবাদ সেফ হোমে ছিলেন। ১৪ বছর পর তাঁকে জিম্মায় নেন তুতুল বাহার। গত বছর পেশায় বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি  নগরের আসাদগঞ্জের বাকপ্রতিবন্ধী লাল মিয়ার সঙ্গে মৌসুমীর বিয়ে দেন। বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় তুতুল বাহারের বাসায়। যোগাযোগ করা হলে মৌসুমী ও লাল মিয়া ভালো আছেন বলেন জানান।

নগরের পাঁচলাইশ বাদুড়তলা বড় গ্যারেজের সামনে একতলা টিনশেড বাড়ি। বাড়িতে থাকেন তুতুল বাহার ও তাঁর বড় বোন লুলুল বাহার। দুজনের কেউই বিয়ে করেননি। অসহায় নারী-শিশুরাই তাঁদের পরিবারের সদস্য।  গত এপ্রিল মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ সাথী আক্তারকে তুতুলের জিম্মায় দেন। এ বাসায় সাথীও আছেন। এখন তাঁর কর্মসংস্থানের চেষ্টা চলছে। সাত বছর বয়সে বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন সাথী।

তুতুল বাহার বললেন, অসহায় মানুষের জন্য কাজ করে তার বিনিময়ে চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। অসহায় মানুষের হাসি থেকে জীবনের সুখ খুঁজে পান তিনি।