এসএ গেমসে তাঁরা ইতিহাস

কাজী শাহানা পারভীন, মাহফুজা খাতুন ও মাবিয়া আক্তার
কাজী শাহানা পারভীন, মাহফুজা খাতুন ও মাবিয়া আক্তার

সেদিনের স্মৃতিটা এখনো জ্বলজ্বল করে কাজী শাহানা পারভীনের মনে। অথচ দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ২৮ বছর। ১৯৯১ সালে কলম্বো গেমসে শুটিংয়ে সোনা জেতেন শাহানা। স্ট্যান্ডার্ড রাইফেলের থ্রি পজিশনে সোনা জিতে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান নারায়ণগঞ্জের এ শুটার। দক্ষিণ এশিয়ান গেমস—এসএ গেমসে বাংলাদেশের সোনাজয়ী প্রথম নারী অ্যাথলেটও যে তিনিই!

 ১৯৮৪ সালে এসএ গেমস শুরু। ১৯৯১ সালে কলম্বোয় পঞ্চম আসরে এসে প্রথম নারী হিসেবে সোনার পদক জেতেন শাহানা।

এ পর্যন্ত ১২টি আসরে সব মিলিয়ে ১৭ জন নারী অ্যাথলেট জিতেছেন সোনার পদক। এর মধ্যে শুটার আটজন—কাজী শাহানা পারভীন, ফারজানা হোসেন, সাবরিনা সুলতানা, লাভলী চৌধুরী, শারমিন আক্তার, শারমিন আক্তার (রত্না), সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা, তৃপ্তি দত্ত। কারাতেতে চারজন—মুন্নী খানম, জ উ প্রু, উসাইনু মারমা ও মরিয়ম খাতুন। তায়কোয়ান্দোতে দুজন—শারমিন ফারজানা রুমি ও শাম্মি আক্তার। সাঁতারে মাহফুজা খাতুন, উশুতে ইতি ইসলাম ও ভারোত্তোলনে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।

দুয়ারে কড়া নাড়ছে আরেকটি এসএ গেমস। আজ ১ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নেপালের কাঠমান্ডু ও পোখারায় বসবে এসএ গেমসের ১৩তম আসর। এবার বাংলাদেশ থেকে ২৬৩ জন পুরুষ এবং ১৯৯ জন নারী অ্যাথলেট খেলতে গেছেন। মোট ২৫টি ইভেন্টে অংশ নেবে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২৩টিতে অংশ নেবেন নারীরা। নারী ফুটবল ও স্কোয়াশ দল এবার খেলতে যায়নি।

প্রথম সোনা জয়ের রোমাঞ্চকর মুহূর্তটার কথা জানতে চাইলে শাহানা ফিরে গেলেন সেই দিনটিতে। মুঠোফোনের অন্য প্রান্ত থেকেও শাহানার উচ্ছ্বাস বোঝা যাচ্ছিল। বললেন, ‘বাংলাদেশের কেউ তখন পর্যন্ত কোনো সোনা জেতেনি। আমি ওই দিন সকালে আল্লাহকে স্মরণ করে ভেন্যুতে গেলাম। শেষ পর্যন্ত যখন সোনা জিতলাম, আমার আনন্দ দেখে কে। আর সেদিন নারায়ণগঞ্জের সবাই আমার খেলা দেখতে টিভি সেটের সামনে বসে ছিলেন। আর টেলিভিশনে যখন আমার নাম ঘোষণা করে, এত জোরে সবাই চিৎকার করেছিলেন যে পুরো শহর নাকি কেঁপে উঠেছিল!’

শুটিংয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা সেভাবে জ্বলে উঠছে না বলে আফসোস করে শাহানা বললেন, ‘আমাদের সময় কোনো আধুনিক রাইফেল ছিল না। বিদেশে গেলে অন্যদের রাইফেলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। অথচ এখন কত আধুনিক অস্ত্র। সুযোগ-সুবিধা উন্নত। কিন্তু সেভাবে সোনার পদক আসছে না।’

 ১৯৯৩ ঢাকা গেমসে স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল প্রোন দলগত ইভেন্টে আবারও সোনা জেতেন শাহানা পারভীন, ফারজানা হোসেন ও সাবরিনা সুলতানা। ১৯৯৯ কাঠমান্ডু গেমসে রাইফেল প্রোন দলগত ইভেন্টে সোনাজয়ী দলে ছিলেন কাজী শাহানা, সাবরিনা সুলতানা ও লাভলী চৌধুরী । ২০০৪ ইসলামাবাদে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জেতেন শারমিন আক্তার। ২০১০ ঢাকা গেমসে মেয়েদের দলগত ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জেতেন শারমিন আক্তার (রত্না), সাদিয়া সুলতানা ও তৃপ্তি দত্ত। সেবার ঢাকা গেমসে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে এককে সোনা জেতেন শারমিন আক্তার (রত্না)। কিন্তু ২০০৬ কলম্বো গেমসে মেয়েরা কোনো খেলাতেই সোনা জিতেননি। এরপর ২০১০ ঢাকা গেমসটা বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য ছিল সোনায় মোড়ানো। কারাতেতে মহিলা দলগত কাতায় সোনা জেতেন মুন্নি খানম, জ উ প্রু ও উসাইনু মারমা। ব্যক্তিগত কাতায় জেতেন জ উ প্রু। কারাতের কুমি ইভেন্টে সোনার পদক গলায় ওঠে মরিয়ম খাতুনের। উশুতে সোনা ইতি ইসলামের। তায়কোয়ান্দোতে শারমিন ফারজানা ও শাম্মি আক্তার হাসেন সোনালি হাসি।

 গত ১০ বছরে শুধু একবার জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনা জিততে পারেননি মরিয়ম খাতুন, সেবার অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। এরপর খেলায় ফিরে ছেলে মুক্তাদির খানকে ক্যাম্পে রেখেই জিতেছেন সোনা। এবারের এসএ গেমসে শুরুর দিকে ক্যাম্পে ছেলেকে সঙ্গে রাখতেন। কিন্তু ফেডারেশন নিষেধ করায় শেষ পর্যন্ত ছেলেকে নানির কাছে রেখে আবাসিক ক্যাম্পে থেকেছেন।

মাঠে ও মাঠের বাইরে সমানে লড়াই করে চলেছেন প্রতিনিয়ত আনসারের এই অ্যাথলেট। এবার নেপালেও সোনা জেতার চ্যালেঞ্জ জানালেন মরিয়ম। বললেন, ‘আমি অনেক কষ্ট করে খেলাটা ধরে রেখেছি। আমার স্বামী এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। নেপালে আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে সোনা জেতার চেষ্টা করব।’

গত আসরেও ছিল মেয়েদের আধিপত্য। শিলং-গুয়াহাটি এসএ গেমসে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে জেতে ৪টি সোনা। এর মধ্যে তিনটিই জেতেন মেয়েরা। ভারোত্তলনে বাংলাদেশের ইতিহাসে মেয়েদের মধ্যে প্রথম সোনা জেতেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। সাঁতারেও মেয়েদের প্রথম সোনা জেতেন মাহফুজা খাতুন। শিলা নামে বেশি পরিচিত এই অ্যাথলেট জেতেন ৫০ ও ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে জেতেন জোড়া সোনা।

আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অবসর নিয়েছেন মাহফুজা। কিন্তু তার পরও এবারের গেমসে নেপালে থাকবেন নৌবাহিনীর সাঁতারু। বাংলাদেশের মার্চপাস্টে পতাকা বাহক থাকবেন মাহফুজা। তাঁকে দেখে অন্য অ্যাথলেটরা যেন অনুপ্রাণিত হন, সেই ভাবনাতেই বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এবারের গেমসে প্রতিটি দলের সঙ্গে একজন করে নারী কোচ পাঠানো হয়েছে নেপালে।

 মাহফুজা বললেন, ‘আমি সেই ২০০৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আছি। তখন থেকে যদি তুলনা করি তাহলে বলব মেয়েদের খেলাধুলা শতকরা ৯৯ ভাগ এগিয়েছে। আগে যেখানে একজন মেয়ে এসএ গেমসে অংশ নিত, এখন সেটা বেড়েছে। দলে মহিলা ফিজিও আছে। সাফল্যও ভালো হচ্ছে।’

 মেয়েরা এসএ গেমসে সোনা জিতলেই পাচ্ছেন ফ্ল্যাট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগেও ভীষণ খুশি মাহফুজা। বললেন, ‘আমরা তো কল্পনাই করিনি যে এত বেশি কিছু পাব। এবারের গেমসে আমার মনে হচ্ছে মেয়েরা অনেক ভালো করবে। বাংলাদেশের পতাকা বারবার ওড়াবে আমাদের মেয়েরা।’

বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপমহাসচিব ও এবারের গেমসের শেফ দ্য মিশন আসাদুজ্জামান কোহিনূর বললেন, ‘আমরা ছেলে ও মেয়েদের খেলার মধ্যে কোনো বৈষম্য করতে চাই না। মাঠে মেধা অনুযায়ী ফল বয়ে আনবেন। তবে এটা সত্য, শুধু মেয়েদের জন্য এবার আলাদা কোচ ও ম্যানেজার নিয়োগের ব্যবস্থা করেছি আমরা। এটা থাকা উচিত। খেলাধুলার মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যেই এগুলো পড়ে।’

 এবারের গেমসে একজন নারী অ্যাথলেট পতাকা বইবেন বাংলাদেশের। আসাদুজ্জামান কোহিনূর বললেন, ‘এই পতাকা বহন করার দায়িত্বটা মাহফুজার প্রাপ্য। আমরা সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছি। উনি মাঠে থাকলে খেলোয়াড়েরা আরও অনুপ্রাণিত হবেন।’