সেই 'কালো' রুবিনাই এখন উদাহরণ

নিজের ড্রাগন ফলের বাগানে রুবিনা খাতুন।  ছবি: সংগৃহীত
নিজের ড্রাগন ফলের বাগানে রুবিনা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

নাটোরের একডালা চাঁদপুর গ্রামের রুবিনা খাতুনের নামের সঙ্গে যোগ হয়ে গেছে ‘কালো মেয়ে’ উপাধি। এই ‘অপরাধেই’ ৩৪ দিনের বেশি স্বামীর সংসার করা হয়নি তাঁর। বাবা নেই। তাই বাবার বাড়ি ফিরে রুবিনার তখন চোখে-মুখে অন্ধকার। একসময় আত্মহত্যা করতে চাওয়া সেই কালো মেয়েই চোখের পানি মুছে সব বাধাকে দুহাতে ঠেলতে লাগলেন। আর আজ সমাজের চোখে রুবিনা যুদ্ধজয়ী এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

রুবিনা কৃষিতে অবদান রাখায় নারী খামারি হিসেবে গত বছর রাষ্ট্রপতির হাত থেকে কেআইবি কৃষি পদক ২০১৮ নিয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন জয়িতাসহ বেশ কয়েকটি সম্মাননা। নিজের আয় করা অর্থে বাড়িঘর মেরামত করেছেন। লাজুক হেসে বললেন, ‘একসময় মা, ভাই ও বোনকে নিয়ে কীভাবে সংসার চলবে, সেই চিন্তা করতাম। আর এখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পারি।’

রুবিনা জানান, ২০১২ সালে মুঠোফোনে বিয়ে হয় সৌদিপ্রবাসী এক তরুণের সঙ্গে। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে দেশে ফেরেন স্বামী। তখন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শুরু হয় সংসার, তবে তা টেকে মাত্র ৩৪ দিন। স্বামী সৌদি চলে যান। শ্বশুরবাড়িতে শুরু হলো নানান অত্যাচার। রুবিনার নামে বড় অভিযোগ, তাঁর গায়ের রং কালো। রুবিনার অভিযোগ, একবার তাঁর ননদ পুকুরে গোসলের নাম করে সাঁতার না–জানা রুবিনাকে পানিতে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। ফোনে সে কথা স্বামীকে জানালে কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তারপর স্বামীর পাঠানো তালাকনামা পেলেন রুবিনা। মা আর ছোট দুই ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে সেই সময় জীবনটা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন রুবিনা।

রুবিনা ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শোনাতে গিয়ে বলেন, ‘আমি চিন্তা করলাম, গায়ের রং কালো বলে সংসার করা হয়নি, তবে অন্য কাজ করতে তো আর কোনো সমস্যা নেই। সেলাইয়ের কাজ জানা ছিল আগে থেকেই। অন্যের কাপড় সেলাই করা শুরু করলাম। কিছুদিন পর একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার দিলাম। ১০ হাজার টাকা লোকসান গুনলেও দ্বিতীয়বার ৩০ হাজার টাকা লাভ হলো। ২০১৫ সালে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দুই লাখ টাকা পুরস্কার পাই। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।’

 জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রুবিনা কৃষিখামারের কাজ শুরু করলেন। বাবার রেখে যাওয়া ১২ বিঘা জমি থেকে প্রথমে দেড় বিঘা জমিতে করলেন পেয়ারাবাগান। বাড়ির পাশের পুকুরে শুরু করলেন মাছের চাষ। পরে নিজেদের জমির সঙ্গে ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে মোট ১৮ বিঘা জমিতে পেয়ারা, লিচু, ড্রাগন, কলা, বরই, আম, নারকেল ও নানান জাতের সবজি চাষ করেন তিনি। বর্তমানে বাড়ির আঙিনায় প্রায় ২০০ কবুতর পালন করছেন রুবিনা। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আয় করছেন।

নাটোর হর্টিকালচার সেন্টারে বছরব্যাপী ‘ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রুবিনা। ফল চাষের সেই প্রশিক্ষণ এখন ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্যদের মধ্যে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ৮ থেকে ১০টি করে বিভিন্ন ফলের গাছও উপহার হিসেবে দেন তিনি। এ ছাড়া আইএফএমসি স্কুল পরিচালনা করে রুবিনা অসহায় নারীদের গরু, হাঁস, মুরগি পালনের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। নির্যাতনের শিকার নারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এতে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে পাচ্ছেন সহায়তা।

নিজের ড্রাগনবাগান ঘুরে দেখাতে গিয়ে রুবিনা বলেন, ‘কালো বলে সংসার হয়নি। লোকেও কম কথা শোনায়নি। এখন সেই লোকেরাই যখন আমার প্রশংসা করে, তখন খুব ভালো লাগে। আমি আমার গায়ের রং বা চেহারা পাল্টাতে পারব না, কিন্তু সমাজের চেহারা তো পালটে দিতে পারব।’