যে পুরস্কার গ্র্যামির চেয়ে বড়

শাকিরা
শাকিরা

লাতিন সংগীতের জগতে শাকিরা জনপ্রিয় এক শিল্পী। কলাম্বীয়া এই গায়িকার খ্যাতি এখন বিশ্বব্যাপী। গানের পাশাপাশি তিনি সমাজসেবার জন্যও পরিচিত। ইউনিসেফের বিশেষ দূত হিসেবে এই তারকা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করেন। গত মাসে তিনি কাতারের ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন সামিট ফর এডুকেশন ২০১৯-এ বক্তৃতা দিয়েছেন, সেটিই থাকল আজ।

অনেকেই আমাকে চেনেন একজন শিল্পী হিসেবে। ১৩ বছর বয়স থেকে এই পরিচয়ে পরিচিত হওয়া আমার জীবনের একমাত্র গন্তব্য ছিল। কিন্তু আমি কোনো দিন কল্পনাও করিনি, এই পরিচয় আমাকে জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত আর বড় লক্ষ্য পূরণের দিকে নিয়ে যেতে এতটা সাহায্য করবে। আমার লক্ষ্য ছিল শিক্ষার শক্তি দিয়ে দারিদ্র্য দূর করা।

কলম্বিয়ার নাগরিক হিসেবে খুব অল্প বয়স থেকেই আমি অসমতার ব্যাপারে জেনেছি। অন্য সব লাতিন দেশের মতো আমার দেশেও কিছু মানুষের কাছে ছিল অঢেল অর্থ–প্রাচুর্য। আবার অনেকের কাছে কিছুই ছিল না। আমরা জানতাম, তুমি যদি দরিদ্র হয়ে জন্মাও, তাহলে খুব সম্ভবত দরিদ্র হয়েই তোমাকে মরতে হবে। যেখানে মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের সমান সুযোগ পায় না, সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তো কুসংস্কার, অক্ষমতা আর ব্যর্থতার জালে জড়িয়েই বাঁচতে হবে। এমনই একটি সমাজব্যবস্থায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম। আমার বয়স যখন আট, তখন দেখতাম আমার বয়সী শিশুরা স্কুলে যাওয়ার বদলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাজ করছে, খালি পায়ে পথে পথে কাজ খুঁজছে। তারা আমার বয়সী, কিন্তু তাদের বাস্তবতা ছিল আমার থেকে একদম আলাদা। এই বাস্তবতা তাদের নিয়তি হয়ে গিয়েছিল। কারণ, তারা জন্মেছিল দরিদ্র পরিবারে। এটাই যেন ছিল তাদের অপরাধ। আমি এটা তখন থেকেই মেনে নিতে পারতাম না। মনে হতো, এমন একটা অন্যায়ের কোনো সমাধান নেই কেন? নিশ্চয়ই এর থেকে বেরোনোর কোনো একটা উপায় আছে। তাই আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, কেন আমার আশপাশের বড় মানুষগুলো (প্রাপ্তবয়স্ক) এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এত নিষ্ক্রিয়? তাঁদের সন্তানের মতো ছোট শিশুরা যেখানে এত কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, সেখানে কেন তাঁরা নির্বিকার?

কফি আনান বলতেন, বিশ্বের এত প্রাচুর্যের মধ্যে দারিদ্র্য অসহনীয়। তাই আমি কিছু সাফল্য পাওয়ার পরই কাজ শুরু করি নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে। আমি কাজ শুরু করি শিশুদের জন্য। শুরুতেই আমি একটা দল বানানোর চেষ্টা করি। যে দলে প্রয়োজন ছিল কিছু পরিশ্রমী, স্বপ্নিল মানুষ, যাঁরা আমার মতো করেই ভাবতে পারেন। যাঁরা সমাজের সেই ভুলগুলোই শোধরাতে চাইতেন, যে ভুলগুলো ছোটবেলা থেকে আমাকে পীড়া দিত। আর এভাবেই আমাদের বেয়ারফুট ফাউন্ডেশনের জন্ম হয়।

আমার বয়স সে সময় ১৮ ছিল। তখনো যথেষ্ট তরুণ ছিলাম। কিন্তু অনড় ছিলাম আমার লক্ষ্যের ব্যাপারে। আমি দৃঢ় ছিলাম যে আমাকে শিশুদের জীবনমানের উন্নয়ন আর শিক্ষা নিয়েই কাজ করতে হবে। যদিও জানতাম না কোন জায়গা থেকে শুরু করব। আমি উপলব্ধি করলাম, আমাকে শুরুতে জানতে হবে, সমাজের এই অনন্তকাল ধরে চলে আসা অসমতা আর সামাজিক গতিশীলতা কমে যাওয়ার শিকড় আসলে কোথায় বোনা। তাই আমি কারণ খুঁজতে শুরু করলাম কেন শিশুরা কাজের জন্য অল্প বয়সেই রাস্তায় নামে। কেন তাদের সহিংস ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িয়ে ঠেলে দেওয়া হয় ঝুঁকির দিকে? কেন এত এত শিশু ভয়ংকর পুষ্টিহীনতায় ভোগে? তখন আমি খুঁজে বের করলাম, আমার দেশের বেশির ভাগ শিশু একটা কারণেই এসব কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। সেই একটিমাত্র কারণ হলো, শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া।

এরপর আমার জন্য সবকিছু পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম, একমাত্র শিক্ষাই পারে তাদের জীবনের কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সুযোগ করে দিতে। কারণ, শিক্ষা হলো সমতা নিশ্চিতকরণের অন্যতম হাতিয়ার।

আমরা যখন কলম্বিয়ায় স্কুল বানাতে শুরু করলাম, প্রথম দিকে আমরা দেশের সবচেয়ে দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো বেছে নিই। সেসব জায়গায় মূলত কিছুই ছিল না। না কোনো অবকাঠামো, না কোনো রাস্তা, না বিদ্যুৎ–সংযোগ আর না বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। আমরা সেসব জায়গায় শুধু স্কুল নয়, তৈরি করতে চেয়েছি সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন শিক্ষার এক অনন্য পরিবেশ। স্কুলের পরিকল্পনা আর পাঠ্যসূচির সঙ্গে আমরা যুক্ত করতে চেয়েছি শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের কর্মসূচি, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও মা-বাবা-শিক্ষকের জন্য সহায়ক প্রশিক্ষণ। আমরা এর সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছি স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারকেও। আমাদের প্রকল্পের সঙ্গে সরকার যুক্ত ছিল কৌশলগত সহযোগী হিসেবে। আধুনিক ও সব সুবিধায় পরিপূর্ণ পরিকল্পনা দিয়ে আমরা তাদের একভাবে বাধ্য করে ফেলেছিলাম এই প্রকল্পে যুক্ত হতে।

শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করাকে অনুপ্রেরণা মনে করেন শাকিরা
শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করাকে অনুপ্রেরণা মনে করেন শাকিরা

একটা সময় লক্ষ করলাম, দুর্গম এলাকায় একটা স্কুল চালু করার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে পুরো এলাকার নকশা। ওই এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন আমাদের বিস্মিত করল। ওই সব জায়গায় অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবস্থা করা হলো বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুৎ–সংযোগের। পাকা রাস্তা তৈরি হতে লাগল। কমতে শুরু করল অপুষ্টি। কিন্তু সবচেয়ে দারুণ যেটা ঘটল তা হলো, স্কুলের শিক্ষার্থীদের অসাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য। যে শিশুরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছিল, পুষ্টিহীনতায় যাদের জীবন ছিল সংকটাপন্ন, সেই শিশুরাই এখন বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। তারা উচ্চশিক্ষার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করছে। কেউ কেউ আবার পড়াশোনার পাশাপাশি এখন ক্রীড়াবিদ, কেউ আবার হয়েছে উদ্যোক্তা।

শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করা সত্যিই দারুণ অনুপ্রেরণার। কারণ, এর ফল খুব দ্রুতই চোখে পড়ে। যারা হারিয়ে যাচ্ছিল, তারা যখন নিজেদের নাম আর পদবি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন মনে হয় এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। গ্র্যামি পুরস্কারের চেয়ে এই অর্জন অনেক বড়।

তবে এখানেই শেষ নয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এখনো আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। কারণ, এখনো অনেক উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে অসমতা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষার আলো সেভাবে ছড়াচ্ছে না। ইতিহাস শুধুই অতীত নয়, ইতিহাস প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে আজকের ওপর ভর করে। তাই আজই আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এগোব, কীভাবে শোধরাব আমাদের ভুলগুলো। এটাই এ সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।

তথ্য মিথ্যা বলে না। আমাদের হাতে যে তথ্য আছে, সেটা স্পষ্ট বলে দেয় শিক্ষা কীভাবে সমাজব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারে। যেমন ধরুন, যদি একটি নিম্ন আয়ের দেশের সব শিক্ষার্থীর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ১৭ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে পারে। প্রশাসনিক পরিবর্তন শুরু হওয়া উচিত তৃণমূল থেকে। উচ্চপর্যায় থেকে পরিবর্তনের সূচনা হলে সেটা কখনো তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছাবে না। এ ক্ষেত্রে একটি দেশের সরকারকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। আর আমাদের মতো যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁদের সব সময় সরকারকে দায়িত্ব পালনের তাগিদ দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও এগিয়ে আসতে হবে, মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হবে।

আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক ছোট ছোট বিষয়ের কারণে একজন শিক্ষার্থী ঝরে যেতে পারে। সেটা হতে পারে স্কুলে যাওয়ার নিরাপদ যানের অভাব কিংবা ভালো ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট না থাকা। একটি শিশুর শিক্ষাজীবন নিরাপদ করতে পারে একটা ছোট বাস, যেটা তাকে বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। শিশুর জন্য নিরাপত্তা ও শিক্ষা নিশ্চিত করা এতটাই সহজ। এতে খরচও কিন্তু বেশি নয়। এ ক্ষেত্রে যে কাজটা সবচেয়ে কঠিন তা হলো, সেই জায়গাগুলো খুঁজে বের করা, যেখানে এখনো কেউ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। কঠিন কাজ হলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝরে পড়া ও স্কুলে না যাওয়া শিশুদের খুঁজে বের করা।

আগামী তিন বছর আমরা শিক্ষাবঞ্চিত ও ঝরে পড়া ৫৪ হাজার শিশুকে শিক্ষার সংস্পর্শ দিতে চাই। এতে প্রায় দুই লাখ ৯৫ হাজার মানুষের জীবন বদলানো সম্ভব। আমরা সামনে আরও স্কুল গড়ব, শিক্ষার্থীদের স্কুলড্রেস বিতরণ করব, স্কুলে থাকাকালীন পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের খাবার ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করব। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকবে, যেন তাঁরা সব সময় শিক্ষাদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, সর্বস্তরের শিশুদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার আমাদের এই চেষ্টা চলতেই থাকবে। পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে না পারা পর্যন্ত আমরা কাজ করে যাব। এটা আমাদের দায়িত্ব এবং আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ।

অনুবাদ: আদর রহমান

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও