আমস্টারডামের পথে বাংলাদেশি তরুণেরা

বাঁ থেকে সেজান, তাসমিয়াহ ও শাহরিয়ার
বাঁ থেকে সেজান, তাসমিয়াহ ও শাহরিয়ার

ডিজিটাল ব্যবসায় পরিকল্পনার প্রতিযোগিতা বাংলালিংক ইনোভেটর্সের তৃতীয় আসরের বিজয়ী হয়েছে সিলভার লাইনিং দল। তাৎক্ষণিকভাবে যানবাহনের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাকে একটি ডিজিটাল পরিকল্পনায় পরিণত করার উদ্ভাবনী ধারণা সবার সামনে তুলে ধরে সিলভার লাইনিং জিতে নেয় সেরার স্বীকৃতি। এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করে লাস্ট মিনিট ও থ্রি অ্যান্ড আ হাফ মেন দল।
গত ২ নভেম্বর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। চ্যাম্পিয়ন দলের চারজনই পাচ্ছেন আগামী জানুয়ারিতে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী অ্যামস্টারডামে অবস্থিত বাংলালিংকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ভিওনের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শনের সুযোগ। এই প্রতিযোগিতার সেরা তিন দল পাচ্ছে সরাসরি বাংলালিংকের ‘স্ট্র্যাটিজিক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম’-এর অ্যাসেসমেন্ট সেন্টারে যোগদানের সুযোগ। তা ছাড়া চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেওয়া দলগুলোর প্রত্যেক সদস্য বাংলালিংকের ‘অ্যাডভান্সড ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম’-এ অংশ নেওয়া সুযোগ পাচ্ছেন। সম্প্রতি বাংলালিংক ইনোভেটর্সের বিজয়ী তিন দলের তিন সদস্যের সঙ্গে আমাদের আড্ডা জমে ওঠে বাংলালিংকের মূল কার্যালয়ে।
বাংলালিংক ইনোভেটর্সের তৃতীয় আসরের যাত্রাটা কীভাবে শুরু হয়েছিল? এই প্রশ্নের জবাব দিতে শুরু করলেন টিম লাস্ট মিনিটের তাসমিয়াহ রহমান। অল্প কথায় পুরো যাত্রার বর্ণনা দিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শেষ বর্ষের এই শিক্ষার্থী। জানালেন, বাংলালিংকের ফেসবুক পেজে প্রতিযোগিতার খবর পাওয়ামাত্রই নিবন্ধন করে ফেলেন তিনি। তাঁর মতো সারা দেশের আরও ১৭ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় নিবন্ধন করেছিলেন। তারপর ছিল ছোট্ট একটা অনলাইন গেমিং রাউন্ড। এই ধাপে পাওয়া স্কোরের ওপর ভিত্তি করে ১৭ হাজার থেকে বাছাই করা হয় সেরা ১১১ জনকে। কোয়ার্টার ফাইনালে সেই ১১১ জনকে বলা হয় পোস্টার প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে। সেখান থেকে বাছাই করা সেরা ৪০ জনকে ভাগ করা হয় ১০টি গ্রুপে। তাঁদের নিয়ে শুরু হয় সেমিফাইনাল। আর এখানে এসেই প্রতিযোগীরা পান এক বিশাল চমক।
‘কী সেই চমক?’ —জানতে চাইলাম চ্যাম্পিয়ন সিলভার লাইনিংয়ের সদস্য শাহরিয়ার রায়হানের কাছে। তিনিও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘সেরা ৪০-এ এসে আমাদের ১০টা গ্রুপে ভাগ করে দেওয়ার পরই আমরা নিজেদের গ্রুপ অন্য সদস্যদের সঙ্গে প্রথমবারের মতো পরিচিত হই। আমরা একেকজন ছিলাম একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের। কেউ আইবিএ, কেউ ইস্ট ওয়েস্ট, কেউ আবার বুয়েটের।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূল চ্যালেঞ্জই ছিল চারটা ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী কতটা দ্রুত একে অপরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। সাভারে আয়োজিত বুট ক্যাম্পে অবশ্য কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই আমাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সবার তখন একটাই লক্ষ্য। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেদের সেরা আইডিয়াটিকে তুলে ধরা।’
এদিকে প্রকৌশলের শিক্ষার্থী সেজান মাহমুদের কৌতূহল বাড়ায় ইনোভেটর্সের রোড শো। ‘দেখি তো বিজনেস কম্পিটিশনে কী হয়?’ এই কৌতূহল থেকেই প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিলেন। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীর দেখাদেখি যোগ দেন তাঁর ব্যাচেরই আরও কয়েকজন। সেরা ১১১-তে টেকার পর আশপাশে আইবিএ আর ব্যবসা-প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের দেখে একসময় খানিকটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলেন সেজান। কিন্তু এরপরও সবকিছুর সঙ্গে একটু একটু করে মানিয়ে নেন তিনি। আর সেরা ৪০-এ যাওয়ার পর তো তিনি একদম আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর।
২০১৭ সালে থেকে আয়োজন করা হচ্ছে বাংলালিংক ইনোভেটর্স। এবার এর তৃতীয় আসর শুরু হয় বছরের মাঝামাঝি থেকে। এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের পেছনে আয়োজকদের মূল উদ্দেশ্য দুটো। প্রথমটি হলো, তরুণদের মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবনী আইডিয়াকে সঠিক প্ল্যাটফর্মে তুলে আনা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, সারা দেশ থেকে ডিজিটাল ট্যালেন্টদের খুঁজে বের করে এনে সরাসরি বাংলালিংকের ‘অ্যাডভান্সড ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম’-এ যুক্ত করা। এরই মধ্যে আগের দুই আসর থেকে এখন পর্যন্ত ১০ জন ইন্টার্ন যোগ দিয়েছেন বাংলালিংকে। আর ৫ জন সুযোগ পেয়েছেন ‘স্ট্র্যাটিজিক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম’-এর অ্যাসেসমেন্ট সেন্টারে যোগ দেওয়ার।
এবারের বাংলালিংক ইনোভেটর্সের মূল থিম ছিল স্মার্ট সিটি ও ডিজিটাল বিজনেস আইডিয়া। তাই গ্রুপ তৈরির পরই দলের সবাই মিলে এ দেশের মূল সমস্যার দিকগুলো খুঁজে বের করেছেন। সেগুলো নিয়ে দলের অন্যদের সঙ্গে ও মেন্টরদের সঙ্গে আলোচনা করেই তৈরি হয়েছেন প্রতিযোগিতার পরবর্তী ধাপের জন্য। সমন্বিত বর্জ্য থেকে তেল উৎপাদন ও প্লাস্টিক রপ্তানি নিয়ে যেমন ভেবেছে টিম লাস্ট মিনিট। অন্যদিকে টিম থ্রি অ্যান্ড আ হাফ ম্যান দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোকে নকলের হাত থেকে বাঁচানোর কথা ভেবেছে।
গত বছরের চ্যাম্পিয়ন টিম কদিন আগেই ঘুরে এসেছে ভিওনের প্রধান কার্যালয়ে। অংশ নিয়েছে দুই দিনের একটি সেমিনারেও। সরাসরি দেখে এসেছে কীভাবে একটা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান কাজ করে। ওদিকে ভিওনের কর্মকর্তারাও বাংলাদেশি তরুণদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাধুবাদ জানিয়েছে বাংলালিংককে এমন একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য।
ফেরার পথে কথা হয় বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশনস সিনিয়র ম্যানেজার আংকিত সুরেকার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আমরা ইনোভেটর্সসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা সব সময় তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে থাকি। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও সুযোগ পেলে তারা তাদের নতুন চিন্তা দিয়ে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।’
ঢাকা থেকে আমস্টারডাম। তারপরের স্বপ্নটা কত দূর? তাসমিয়াহ জানালেন, টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরের সঙ্গেই যুক্ত থাকার কথা। সাকিব জানালেন বেশ কবছর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চান তিনি। আর সেজান মুচকি হাসলেন। কিছুই তেমন বললেন না। স্বপ্নটা না হয় তাঁর একান্তই থাক।