দিনাজপুর এলাকায় আমার মুক্তিযুদ্ধ

বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করছেন দিনাজপুরে। ছবি: সংগৃহীত
বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করছেন দিনাজপুরে। ছবি: সংগৃহীত
>১৯৭১ সালে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন মো. সিদ্দিকুল হক। দেশ স্বাধীন করার ডাকে সাড়া দিয়ে কিশোর বয়সেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর বীরত্বগাথা ছাপা হয়েছে প্রথমা থেকে প্রকাশিত সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১ বইতে। মো. সিদ্দিকুল হকের লেখার একটি অংশ ছাপা হলো আজ।

১৯৭১ সাল। আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। সবেমাত্র দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। ভেতরে-ভেতরে চরম উত্তেজনা, নতুন ক্লাস শুরু করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ক্লাস ঠিকমতো হচ্ছিল না, দেশজুড়ে চলছে আন্দোলন। দেশের জনগণ অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছে। একাত্তরের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে দুর্বার গতিসঞ্চার করে। ২৫ মার্চ থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের বর্বরোচিত গণহত্যা গোটা জাতিকে হতবাক করে দেয়। স্বাধিকার আদায়ে অঙ্গীকারবদ্ধ বাঙালি জাতি প্রতিরোধ আর আত্মরক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ত হওয়ার কাহিনি অনেক লম্বা। আমি সেদিকে যাব না। বলছি আমার মুক্তিযোদ্ধা জীবনের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা। 

ভারতের পানিঘাটা প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের আঙ্গিনাবাদ এলাকার বরাহার শিবিরে। মূলত এটা ছিল একটা ট্রানজিট ক্যাম্প। সে সময় এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এস এম বাট। সেখানে এক বা দুই দিন থাকার পর জুলাই মাসের শেষের দিকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ীর কোনো একটা গ্রামে। এই গ্রামকে আমরা হাইড আউট (গোপন আস্তানা) হিসেবে ব্যবহার করে টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ করব। গ্রামটা ছিল পুরোপুরি পরিত্যক্ত। কোনো একদিন রাতে আমরা সেখানে পৌঁছালাম, পুরো দুই দিন গ্রামের আশপাশের এলাকাটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা হলো। দুই দিন পর ঠিক হলো, আমরা অপারেশনে বের হব। 

আমার কমান্ডার আবদুল লতিফ, পাকিস্তান মুজাহিদ বাহিনীর (১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাকিস্তান সরকার এই বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনী সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল এবং এর বেশির ভাগ সদস্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন) একজন সদস্য ছিলেন। অত্যন্ত ঠান্ডা এবং ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ। স্থির হলো রাতের কোনো একসময় আমরা অপারেশনে যাব। এ জন্য আমরা একটু আগেভাগে খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করলাম। অবশ্য আমরা এমনিতেও রাতের প্রথম ভাগেই খাওয়া শেষ করতাম। সন্ধ্যার পরপরই এক লোক এলেন। লোকটি আমাদের কমান্ডারের পূর্বপরিচিত। রাতের অপারেশনে তিনি আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করবেন। আরও বড় কথা, তিনি সেখানকার স্থানীয় মানুষ। সন্ধ্যার অল্প পরই আমরা ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের দলের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৩। অপারেশন স্কট আমাদের হাইড আউট থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরে। শেষ রাতের কাছাকাছি সময়ে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম গাছপালায় ঘেরা আরেক গ্রামে। এটাও পরিত্যক্ত। ঘরবাড়ির দেয়াল আধা ভাঙা, বেশির ভাগ ঘরের চালা নেই। পুরো যাত্রাপথে অনুমানের ওপর ভর করে পথ চলতে হয়েছে। জীবনে প্রথম রাতের নিশ্ছিদ্র আঁধারে গ্রামের রাস্তায় পথচলা। পুবের আকাশ কিছুটা ফিকে হতে শুরু করেছে। গ্রামের পুরো অবয়বটা এখন কিছুটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। গ্রামের পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি কাঁচা সড়ক চলে গেছে। আমরা যে বাড়িগুলো বা পাড়ায় অবস্থান নিয়েছি, তার কিছুটা উত্তর দিক দিয়ে একটা ছোট খাঁড়ি বয়ে গেছে। খাঁড়িটার গভীরতা খুব বেশি না হলেও পানি ছিল প্রায় বুকসমান। খাঁড়িটার দুই ধারে প্রচুর বাঁশঝাড়। 

মুক্তিযুদ্ধকালীন লেখকের পরিচয়পত্র
মুক্তিযুদ্ধকালীন লেখকের পরিচয়পত্র

আমরা কমান্ডারের নির্দেশমতো নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করে নিয়ে সুবিধামতো জায়গায় পজিশন নিলাম। এরই মধ্যে চারদিক পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের আজকের অপারেশনের অংশ হলো গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে যে সড়ক চলে গেছে, তার ওপর নজর রাখা। প্রতিদিন সকাল ৯-১০টার মধ্যে পার্শ্ববর্তী চিন্তামনের ক্যাম্প থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল পুরো এলাকা টহল দিতে আসে। ওই দলের ওপর ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এখানে একটি কথা বলে নিই। প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের যুদ্ধটা ছিল সম্পূর্ণ গেরিলা পদ্ধতির। সুযোগ বুঝে শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজেকে নিরাপদ রেখে যত দ্রুত পারা যায় অন্যত্র চলে যাওয়া। আমাদের এই অপারেশনের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল এর বিপরীত। 

যা-ই হোক, অপেক্ষার পালা শুরু হলো। সময় যেন কিছুতেই যেতে চায় না। একেকটা মিনিট যেন একেকটা ঘণ্টা। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। সকাল নয়টা বা সাড়ে নয়টায় গ্রামের সেই পথে কতগুলো অবয়ব দেখা দিল এবং আস্তে আস্তে সেগুলো মানুষে রূপান্তরিত হলো। মোট সাতজনের দলটির প্রত্যেকে সামরিক পোশাক আর সামরিক অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত। এরা অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতেই চলছিল। ক্রমেই নিকটে আসতে লাগল। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। হৃৎস্পন্দনের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। জীবনের প্রথম অপারেশন। তা-ও আবার দিনের বেলায়। আমি সমানে ঘামতে লাগলাম। আমার মনে হয়, শুধু আমি নই, দলের সবার অবস্থাই আমার মতো হয়েছিল। কারণ, কমান্ডার বাদে আমাদের প্রায় সবারই এটা প্রথম অপারেশন ছিল। ভেতরে-ভেতরে চরম উত্তেজিত হতে লাগলাম। একে তো নতুন জায়গা, তার ওপর দলের সবার সঙ্গে এখনো পর্যন্ত সখ্য গড়ে ওঠেনি। সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মনে মনে যুদ্ধের কৌশলগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম। 

মাথা একেবারে ঠান্ডা রাখতে হবে। কোনো রকম তাড়াহুড়ো নয়। একেবারে শান্ত থাকতে হবে। টার্গেট ক্রমেই এগিয়ে আসছে। রাইফেলের ট্রিগারে আঙুল রেখে নিশ্বাস বন্ধ করে নির্দেশের অপেক্ষা। হঠাৎ আমার ডান পাশে একটা রাইফেল গর্জে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে একজন শত্রুসেনা ধরাশায়ী হলো। খুব উত্তেজনা বোধ করছি। আবার ভেতরে-ভেতরে ভীষণ ভয়ও হচ্ছে। আনন্দ আর উত্তেজনা মিলে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া অনুভব করছি। ঘটনাটা চোখের নিমেষে ঘটে গেল। অল্প কয়েক সেকেন্ড বা মিনিটের বিরতি। তারপর পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেল। আমাদের অবস্থান লক্ষ্য করে শুরু হলো বৃষ্টির মতো গুলি। নিরবচ্ছিন্নভাবে চলল। এর মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা তাদের আহত বা নিহত সঙ্গীকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে গেছে। আমরা যে যার অবস্থান থেকে শত্রুসেনার ওপর আক্রমণ চালাচ্ছি। আমরা একটা গুলি ছুড়লে তারা ছুড়ছে একঝাঁক। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির বৃষ্টি, মাথা তুলে সামনে কিছু দেখার উপায় নেই। 

মো. সিদ্দিকুল হক
মো. সিদ্দিকুল হক

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তাপও বেড়ে গেছে। তার ওপর আমি যে জায়গায় অবস্থান নিয়েছি, সেই জায়গাটায় কোনো গাছপালা নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার ডান দিকে যে কয়টা মোটা গাছ আছে, ঠিক ওদিকেই সরে যাব। নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে গাছগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ করলাম, একটা পা দেখা যাচ্ছে। ভালোই হলো, দুজনে একযোগে আক্রমণ করা যাবে। পা লক্ষ করে আমার এগিয়ে যাওয়ার গতিটা আরেকটু দ্রুত হলো। তার কাছে পৌঁছামাত্রই আমার শরীর যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। চোখের সামনে যা দেখলাম, তা বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার একজন সহযোদ্ধা, হারুন-অর-রশিদ, গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মাথাটা ঝুলে আছে বুকের ওপর। বুকের বাঁ পাশে ছোট একটি ফুটো, যা পেছন দিকে বিশাল একটা ক্ষতের সৃষ্টি করে বেরিয়ে গেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনাটা কখন ঘটেছে, গোলাগুলির শব্দে কিছুই টের পাইনি। আমার সবকিছুই কেমন যেন ওলটপালট হতে শুরু করল। এ অবস্থায় কী করব, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। বেলা তখন কত হবে, মনে নেই। ততক্ষণে আমাদের অবস্থান লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন সেনা, ব্রিটিশ এলএমজি আর দুই ইঞ্চি মর্টার থেকে গোলাবর্ষণ। কোনো দিকে তাকানোর অবকাশ নেই। এখন যেন নিজেকে রক্ষা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

শত্রুসেনাদের আক্রমণের গতি যেমন বেড়েছে, আমাদের গতি তেমনই কমেছে। কারণ, আমাদের রসদ ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। শত্রুসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে, এমন পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি কোনোটাই আমাদের ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বাধ্য হয়েই তাদের সঙ্গে, অর্থাৎ পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি। তাদের দলের সদস্য আর রসদ ও গোলাবারুদ সবই বেড়েছে। আর আমাদের ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি, কিছুক্ষণ আগেও আমার আশপাশে যারা ছিল, তারা মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা আর কিছুই ভাবতে পারছি না। হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে সরে এলাম। খাঁড়ির দিকে মাঝেমধ্যে পজিশন বদল করে এগিয়ে যাচ্ছি আর দু-একটা করে ফায়ার করছি, যাতে তারা বুঝতে না পারে যে আমরা সরে পড়ছি। অবশ্য এই মুহূর্তে তারা আমাদের ওপর খুব চড়াও হলে আমরা বেশির ভাগই মারা পড়তাম। আসলে সম্মুখযুদ্ধের যে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, তার কোনোটাই আমাদের ছিল না। 

সেদিনের ওই পরিস্থিতি আমাকে যেন অনেকটাই যুদ্ধে অভিজ্ঞ করে তুলেছিল। সবকিছু ভুলে গিয়ে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার শক্তি পেতে থাকি আমার ভেতর থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে খাঁড়ির পানিতে নেমে পড়লাম। গোলাগুলির তীব্রতা তখন একটু কমেছে। পুরোপুরি থেমে যায়নি। আমার দলের অন্য সহযোদ্ধাদের গুলির শব্দ লক্ষ্য করে তাদের অবস্থানের দিকে যেতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছে, খাঁড়ির পানিতে নেমে যেন আরও একটা ভুল করলাম। কারণ, খাঁড়ির দুই ধারে যে বাঁশের ঝাড়গুলো ছিল, পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলি আর গোলার স্প্লিন্টারগুলো বাঁশের গায়ে লেগে এদিক-সেদিক হেলতে লাগল। যেকোনো সময় আমাকে আঘাত করতে পারত। সব সামলে আমি দলের দিকে এগোতে থাকলাম। এখন যেখানে আমরা একত্র হতে যাচ্ছি, সেটা একটা স্কুলঘর। এই জায়গাটা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা ছিল। 

এখানে আসার পর মনে হচ্ছে যেন আমি কত দিন ধরে খাইনি! ক্ষুধার চোটে মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে, সম্পূর্ণ শরীর থরথর করে কাঁপছে। দাপাদাপি আর যুদ্ধের উত্তেজনায় ক্ষুধার কথা সবাই মনে হয় ভুলেই গিয়েছিলাম। গোলাগুলির শব্দ থেমে গেছে, দু-তিনজন ছাড়া আমাদের সবাই ফিরে এসেছে। দু-একজন অল্প আহত হয়েছে। শহীদ হয়েছে একজন।