'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' আন্নার অনুবাদে

আন্না কোক্কিয়ারেল্লা।  ছবি: হাসান রাজা
আন্না কোক্কিয়ারেল্লা। ছবি: হাসান রাজা

‘বাংলাদেশ সম্পর্কে পৃথিবীর সবাই জানবে, আমার ইচ্ছা। আর বাংলাদেশকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতে হবে। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা। বইটি পড়ার পরেই এটি অনুবাদের আগ্রহ জন্মেছিল।’

ইতালির গবেষক ও অনুবাদক আন্না কোক্কিয়ারেল্লা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অনুবাদের কারণ এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন। বইটি তিনি ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এখন ইতালির কোনো এক প্রেসে ছাপার অপেক্ষায়। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধুর লেখা বইটি অনুবাদের কাজে হাত দেন ইতালির দক্ষিণের শহর বেনেভেন্তোর এই নারী।

আন্না বললেন, কাজ করতে গিয়ে কিছু আঞ্চলিক শব্দ বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। একজনের সহযোগিতায় সে সমস্যা সহজেই উতরে গেছেন। তবে ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রকে ব্যক্তিগতভাবে না চেনায় চরিত্রগুলো আলাদা করতে এবং মনে রাখতে বেশ খাটুনি হয়েছে। দেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ও দৃঢ় মনোভাব আন্নাকে বাংলাদেশকে ভালোবাসতে প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে বলে জানান।

সম্প্রতি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কথা হয় আন্নার সঙ্গে। ৪০ বছর বয়সী এই নারী জানান, ২০০০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে প্রথম বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন। নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য জীবন দেওয়ার ঘটনা ভীষণভাবে আলোড়িত করে তাঁকে। সেই আগ্রহ থেকে ২০০৩ সালে বাংলাদেশে ঘুরতে আসেন। বাংলা ভাষার মিষ্টতায় মুগ্ধ হয়ে পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন ভাষা শিখতে। কোর্স শেষে দুই বছর পরে ফিরে যান ইতালি। কিন্তু মন পড়ে থাকে বহু দূরের এই বঙ্গদেশে।

 আন্না বাংলা লিখতে, পড়তে ও বলতে পারেন। বাংলায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য, যদিও কিছু শব্দে এখনো জড়তা আছে। এমনকি কোনো বাঙালি ইংরেজিতে কিছু জানতে চাইলেও তিনি বাংলায় উত্তর দেন। তিনি বলেন, ‘যখন দুজন বাঙালি নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলেন, তখন খুব রাগ হয়। এত মিষ্টি, এত সমৃদ্ধ ভাষা ছেড়ে কেউ অন্য ভাষায় কথা বলে!’ এমনকি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ১৯৭১-এর গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও তিনি বাংলায় বক্তব্য দেন।

বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা পড়ে স্বাভাবিক থাকতে পারেননি আন্না। তিনি জানান, ১০০ পৃষ্ঠার একটি বই পড়তে তাঁর ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। অথচ এমন একটি বই শেষ করতে তাঁর দুই মাসের বেশি সময় লেগেছে।

কিছুটা আক্ষেপ এবং ক্ষোভের সঙ্গে আন্না বললেন, যুদ্ধ শেষে এই নারীরা ‘হিরোইন’ হিসেবে ঘরে ফিরতে পারেননি। পুরুষশাসিত দৃষ্টিভঙ্গিকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, বিষয়টি এমন যেন এই নারীরা যেচে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এমনকি ‘আমি বীরাঙ্গনা’ কথাটি সাহস করে ও গর্ব নিয়ে তাঁরা বলতে পারেন না।

বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার নারীদের বীরাঙ্গনা নয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্না এখন এই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন সুফির মাজার ও আখড়া ঘুরে বাংলার সুফিবাদ নিয়েও কাজ করেছেন। আন্না রোমের ল্যা স্যাপিয়েনজো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, আরবি, তিব্বতি, স্প্যানিশসহ নানান ভাষায় দক্ষতা অর্জন করলেও বাংলার প্রতি তাঁর টান অত্যন্ত গভীর।

আন্না বিয়ে করেছেন এক বাঙালিকে। থিতু হতে চান বাংলাদেশেই। বাংলাদেশ নিয়ে ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ তাঁর কথায় ঝরে, পোশাকে ফুটে ওঠে। এমনকি বাঁ হাতের ট্যাটুও সে ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে বলছে, ‘যদি নতুন কোনো জন্ম থাকে...’।