পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড: সাবেকদের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে প্রতিযোগিতা বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াড ১০ বছরে পা দিয়েছে। তবে এই ছোট্ট পথেই নানা রকম অর্জন এই আয়োজনের ঝুলিতে এসেছে। এই আয়োজনের সাবেক অংশগ্রহণকারীরা ছড়িয়ে আছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রতিষ্ঠানে, অংশ নিচ্ছেন বিশ্বের সম্ভাবনাময় সব গবেষণায়। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে ই-মেইল, ফোন আর মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। তাঁদের ফিজিকস অলিম্পিয়াডের দিনগুলোর অভিজ্ঞতা শুনেছেন আলিমুজ্জামান।

অবন্তী বসাক
অবন্তী বসাক

ভালোবাসা থেকে চলুক চর্চা
অবন্তী বসাক
ছেলেবেলা থেকেই পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধান করতে ভালোবাসতাম। ক্লাসের পড়ার বইয়ের বাইরেও নানা রকম বই থেকে এসব সমস্যা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করতাম। ২০১১ সালে জাতীয় ফিজিকস অলিম্পিয়াডের বাছাইপর্বে অংশ নিই আমি। সেখান থেকে নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে তিন মাসের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। ক্যাম্প শেষে আমাদের পাঁচজনের দল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নিই।
প্রথমবারের মতো পরিবার ছাড়া দেশের বাইরে গিয়েছিলাম আমি। এদিকে আমাদের কারও ধারণাই ছিল না কী ধরনের পরীক্ষা হবে, কেমন করে সমাধান করতে হবে। সে বছর আমিসহ দলের আরেকজনফিজিকস অলিম্পিয়াডে অনারেবল মেনশন পায়। আর আমাকে ‘সেরা নবাগত’ প্রতিযোগীর সম্মাননা দেওয়া হয়।
ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ আমার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সমস্যা সমাধানে যেহেতু আগে থেকেই ঝোঁক ছিল, তাই নিজের সেরাটা এখানে দিতে কষ্ট হয়নি। ভালো লাগা ছিল বলেই একাডেমিক পড়াশোনা শেষেও অলিম্পিয়াডের জন্য সময় বের করতে পেরেছিলাম। এখন যারা অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে আসে, তাদের জন্য বলব, যদি তোমার সমস্যা সমাধানের প্রতি আগ্রহ থাকে, ভালোবাসা থাকে, তবেই এটায় অংশ নাও। সবার জন্য অলিম্পিয়াড করা জরুরি না। কিন্তু যে করবে, সে যেন তার সেরাটা নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। যদি ভালোবাসা থাকে, তবেই চালিয়ে যাও অলিম্পিয়াডের চর্চা।

লেখক: বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী প্রথম দলের সদস্য, প্রথম অনারেবল পদকপ্রাপ্তদের একজন অবন্তী। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষ করে বর্তমানে স্যান্টা বারবারার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় কম্পিউটার প্রকৌশলে পিএইচডি করছেন।

দেবপ্রিয় বিশ্বাস
দেবপ্রিয় বিশ্বাস

সহজ অবস্থান থেকে বের হতে হবে
দেবপ্রিয় বিশ্বাস
ছোটবেলায় বাবা আমাকে একটা এনসাইক্লোপিডিয়া উপহার দিয়েছিলেন। মা একটু পড়াশোনা নিয়ে জোর দিলেও বাবা সব সময় নতুন কিছু শেখাতে চাইতেন। রঙিন ছবিতে কত শত জানা-অজানা বিষয় ছিল সেখানে। সেসব দেখে দেখেই আমার ভেতর চারপাশের সবকিছু নিয়ে জানার আগ্রহ জন্মেছিল। সেই থেকেই হয়তো পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি এভাবে আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করি।
২০১১ সালে যখন বাংলাদেশে ফিজিকস অলিম্পিয়াড শুরু হয়, তখন থেকেই একটু একটু করে প্রস্তুতি নিতাম আমি। আমাদের ও লেভেল/এ লেভেলের সিলেবাসে পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানের অতটা সুযোগ না থাকলেও পড়ার বইয়ের বাইরে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধানের চেষ্টা করতাম। ২০১২ সালে জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনে ছোটদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরে ২০১৩ সালে আমি এতে বেশি জোর দিই। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ পাই।
সে বছর আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডের আসর বসেছিল কাজাখস্তানের আছানা শহরে। এই শহর থেকেই রাশিয়ার প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। তাই ইতিহাস আর বিজ্ঞান মিলিয়ে অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল এই শহরে। আমাদের রুমমেট ছিল তুরস্কের। সেবার আমিসহ দলের আরেকজন সদস্য অনারেবল পদক পায়।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি অলিম্পিয়াড করে যাওয়াটা একটু কষ্টসাধ্য। তবে ভালোবাসা থাকলে সেটা অসম্ভব নয়। নতুন যারা ফিজিকস অলিম্পিয়াড শুরু করছ, তারা পুরোনো প্রশ্ন সমাধান করতে পারো। অলিম্পিয়াডে ভালো করার জন্য আমাদের সহজ অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

লেখক: ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অনারেবল পদক পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষ করে বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে পিএইচডি করছেন।

অর্পণ পাল
অর্পণ পাল

এই অভিজ্ঞতা আমাকে এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর
অর্পণ পাল
আমি অনেক আগে থেকেই পদার্থবিজ্ঞান পছন্দ করতাম। কিন্তু অনলাইনে সক্রিয় না থাকার জন্য সেভাবে খবর পাইনি। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো অংশ নিই এই আয়োজনে। তখন আমি উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষে ছিলাম। তাই সেবারই ছিল আমার শেষ সুযোগ। ওই বছর ঢাকা আঞ্চলিক অলিম্পিয়াডে প্রথম হওয়ার পর জাতীয় অলিম্পিয়াডে তৃতীয় হই। এরপর জাতীয় পর্যায়ের ক্যাম্পে ডাক পাই। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই।
ভারতের মুম্বাই শহরে বসেছিল সেবারের আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডের আসর। বাংলাদেশ দলের অর্জন ছিল একটি ব্রোঞ্জ ও একটি অনারেবল পদক। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেবার ভালো না করতে পারলেও এই অভিজ্ঞতা আমাকে এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর।
ফিজিকস অলিম্পিয়াডের ফেসবুক পেজে কিছু নোট লেখা আছে, কীভাবে ফিজিকস অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে, কী কী বই ফলো করা যেতে পারে ইত্যাদি নিয়ে। নতুন যারা অংশ নিতে চায়, তাদের জন্য সেগুলো সহায়ক হবে সঠিক দিকনির্দেশনা পেতে।

েলখক: ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলের সদস্য। পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষে।

ইশতিয়াক আকিব
ইশতিয়াক আকিব

সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন উন্মুক্ত
ইশতিয়াক আকিব
আমি ২০১৫ সালে প্রথম ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নিই। ঢাকার বাইরে বসে ভালো করলেও সেই বছর এসএসসি পরীক্ষার জন্য জাতীয় পর্বে অংশ নিতে পারিনি। এর পরের দুই বছর নটর ডেম কলেজে পড়ার সুবাদে ঢাকায় থাকার সুযোগ হয় আমার। তাই দুই বছরই ভালো ফল ধরে রেখে জাতীয় ক্যাম্পে সুযোগ পাই। তবে কখনো আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডের বাংলাদেশ দলে জায়গা পাইনি। এরপর থেকে ফিজিকস অলিম্পিয়াডের সঙ্গে একাডেমিক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত আছি।
ফিজিকস অলিম্পিয়াড যারা করে, তারা বেশির ভাগই পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই করে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা নিঃসন্দেহে বড় একটা বিষয়; সেটা করার সুযোগ পায় অল্প কজনই। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানকে ভালো করে শেখা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন সবার জন্যই উন্মুক্ত। গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে এসে অলিম্পিয়াড ওই নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে শেখাচ্ছে।
অলিম্পিয়াডের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হলো অজানা একটা সমস্যায় ঘাবড়ে না গিয়ে সেটা সমাধান করতে পারা। আবার গবেষণার ক্ষেত্রেও অনেকটা একই কাজ হয়। তাই অলিম্পিয়াড গবেষণার জন্য দরকার দক্ষতা ও মানসিকতা।

লেখক: জাতীয় ফিজিকস অলিম্পিয়াডের একাডেমিক স্বেচ্ছাসেবক। বর্তমানে কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করছেন।

বছরজুড়ে সমস্যা সমাধানের চর্চা করতে হবে
আরশাদ মোমেন
কোচ, জাতীয় ফিজিকস অলিম্পিয়াড, অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফিজিকস অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে খুব বেশি ‘আউট’ (বাইরের) বই পড়তে হয় না। আবার শুধু ক্লাসের বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলবে না। এর কারণ, অলিম্পিয়াডগুলো স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা নয়। যেহেতু এই প্রতিযোগিতায় পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা পরখ করা হয়, এ কারণে প্রতিযোগিতায় ভালো করার জন্য শিক্ষার্থীদের একটু ওপরের পর্যায়ের বই পড়তে হবে। যেমন—‘এ’ ক্যাটাগরির প্রতিযোগীদের দরকার ‘বি’ ক্যাটাগরি, অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণির জন্য লেখা পাঠ্যপুস্তকটা পড়া। তবে ‘সি’ ক্যাটাগরি প্রতিযোগীদের সে জন্য পড়তে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ানো সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের বই, যেমন—হ্যালিডে ও রেসনিকের লেখা বইটা নেড়েচেড়ে দেখা। তবে সে জন্য শিক্ষার্থীদের ক্যালকুলাস শেখা প্রয়োজন। সেটা অবশ্য সব বিজ্ঞানশিক্ষার্থীদেরই শিখতে হয়। আর যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেটা হলো বছরজুড়ে সমস্যা সমাধানের চর্চাটা করা। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিযোগীই যেটা করে, তা হলো অলিম্পিয়াডের শিডিউল আর নিবন্ধনের ঘোষণা দেওয়ার পর পুরোনো প্রশ্নগুলোর সমাধান শুরু করে। এ জন্য তারা তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।