ভাস্কর্যে ভাস্বর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

>দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে স্থাপিত হয়েছে ভাস্কর্য। এসব ভাস্কর্য তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নিয়ে এবারের আয়োজন।
অপরাজেয় বাংলা, ভাস্কর: সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ
অপরাজেয় বাংলা, ভাস্কর: সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অপরাজেয়র অনুপ্রেরণা
সজল কুমার কুন্ডু
ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম কিংবা যেকোনো গণ–আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তার উত্তর বোধ করি এখানকার ভাস্কর্যগুলো ভালোভাবেই বহন করছে। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক আবেদন ফুটে উঠেছে যেসব স্থাপত্যশৈলীতে, কলাভবনের সামনে অবস্থিত সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ নির্মিত ‘অপরাজেয় বাংলা’ তাদের মধ্যে অন্যতম। ব–দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো এক স্কুলে কাদামাটি গায়ে মেখে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলোর ক্যালেন্ডারের চটকদার প্রচারণা—কোথায় নেই এই ভাস্কর্যের প্রতিচ্ছবি!

উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতাম। তখন ক্যাম্পাসের সব জায়গায় সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোর খুব প্রচলন ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থীর কাছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি স্বপ্নের নাম। তখন ক্যাম্পাসের সব জায়গা ভালোভাবে চিনতাম না। এ রকমভাবেই একদিন বড় ভাইদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে সোডিয়ামের হলুদ আলোয় প্রস্ফুটিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অমোঘ ইতিহাসের সাক্ষী ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যের কোনো জায়গায় ভাস্করের নাম দেখতে না পেয়ে বড় ভাইদের কাছে এই ভাস্কর্যের আদি–অন্ত জানতে চাওয়া। সেদিন তাঁরা সাধ্যমতো আমার কৌতূহল নিবারণের চেষ্টা করেছিলেন।
তখন ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে ‘যদি তোমার হতে পারতাম!’ ধরনের অনুভূতি কাজ করেছিল। সেদিন কেমন একটা অব্যক্ত মর্মস্পর্শী আবেগ নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম। অবশেষে ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সৌভাগ্য হলো। প্রথম ক্লাস করার পর বিকেলবেলায় ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে ভুলিনি।
এখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই অপরাজেয় বাংলার সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করি। ক্লাস, পরীক্ষা, আড্ডা, গ্রুপ স্টাডি—সবই এখন এই ভাস্কর্যকেন্দ্রিক। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত অথবা সকাল, দুপুর কিংবা সন্ধ্যা—সব সময়ই অপরাজেয় বাংলা আমাকে নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে।
কলাভবনের সামনের সংস্কার করা ঐতিহাসিক বটতলায় বসে অপরাজেয় বাংলার সৌন্দর্য আরও ভালোভাবে অবলোকন করা যায়। এখন প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষকে এই স্থাপত্যের সঙ্গে ছবি তুলতে দেখি। বিশেষ করে কলেজের পোশাক পরা কোনো ছাত্রকে দেখলে একটু বেশিই আবেগতাড়িত হই। ওদের মধ্যে আমি স্পষ্টভাবে যেন আমাকেই দেখতে পাই। সমাবর্তনের সময় এই ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তোলেন না, এমন গ্র্যাজুয়েট বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একদিন হয়তো আমারও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চলে যেতে হবে কোনো এক অজানা গন্তব্যে। কিন্তু আমার হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সাক্ষী এই ‘অপরাজেয় বাংলা’ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে ধারণ করে, নান্দনিক শোভা নিয়ে মাথা উঁচু করে।

সাবাস বাংলাদেশ, ভাস্কর: নিতুন কুন্ডু
সাবাস বাংলাদেশ, ভাস্কর: নিতুন কুন্ডু

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সাবাস বাংলাদেশ
কাজী জহিরুল ইসলাম
ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্য যেসব ভাস্কর্য আছে, তার মধ্যে অন্যতম ‘সাবাস বাংলাদেশ’। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের পাশে অবস্থিত। যুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে। শামসুজ্জোহা, হবিবুর, সুখরঞ্জন সমাদ্দারসহ অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে দেশকে স্বাধীন করার তাগিদে। শহীদদের স্মৃতিকে চির–অম্লান করার জন্য ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে শিল্পী নিতুন কুন্ডু এটি তৈরি করেন। এ স্থাপত্যের দিকে তাকালেই আমরা অনুধাবন করি যুদ্ধের সময় বাংলা মায়ের তরুণ সন্তানদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের মহিমার কথা। বাংলার তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা কীভাবে জীবনের মায়াকে তোয়াক্কা না করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করল, সেই দৃশ্যের প্রতিফলন দেখা যায় ভাস্কর্যে। এ ছাড়া তরুণ যুবকের এক হাতে বন্দুক, অন্য হাতে প্রতিরোধের চিহ্ন দেখা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ, তার প্রমাণ বহন করে ভাস্কর্যটি।
এই ভাস্কর্য স্মরণ করিয়ে দেয়, অতীতকে ভুলে যেয়ো না; অতীতের ওপর বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে; যে বর্তমানের ভিত্তিমূলে নির্মিত হবে ভবিষ্যৎ।

সাত বীরশ্রেষ্ঠের আবক্ষ ভাস্কর্যের ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী
সাত বীরশ্রেষ্ঠের আবক্ষ ভাস্কর্যের ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সাত বীরশ্রেষ্ঠের মুখ
রেজাউল ইসলাম
কৃষি অনুষদ, চতুর্থ বর্ষ
ছায়াঘেরা, শান্ত, সুনিবিড় পরিবেশে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের ক্যাম্পাসে একটা দৃষ্টিনন্দন লেক আছে, আছে নান্দনিক বাংলো ঘর, কারুকার্যসংবলিত সেতু, লেকের পাড়ে সুন্দর বসার জায়গা, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য—জয় বাংলা। আরও আছে সাত বীরশ্রেষ্ঠের আবক্ষ ভাস্কর্য। প্রতিদিন আশপাশ থেকে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসেন, একটু সময়ের জন্য হলেও তাঁরা থমকে দাঁড়ান এই ভাস্কর্যের সামনে।
২০১৬ সালে আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠের আবক্ষ ভাস্কর্যসংবলিত এই স্মারক উন্মোচন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। বীরশ্রেষ্ঠদের জন্মতারিখ ও জন্মস্থান, কর্মজীবন, মৃত্যুর তারিখ ইত্যাদি লেখা আছে তাঁদের প্রতিকৃতির নিচে। ভাস্কর্যের সামনের সবুজ ঘাসে বসে আমরা যখন আড্ডা দিই, বারবার চোখ চলে যায় ওই মুখগুলোর দিকে। শ্রদ্ধার পাশাপাশি কেমন একটা গর্ববোধ হয়। রাতের আলোয় সাত বীরশ্রেষ্ঠকে আরও মহিমান্বিত মনে হয়।

জয়িতা–৭১, ভাস্কর: এহসানুল আহ্সান খান
জয়িতা–৭১, ভাস্কর: এহসানুল আহ্সান খান

ইডেন মহিলা কলেজ
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা
সৈয়দা জাহিন তাসনীম
পরিসংখ্যান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ
ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজে প্রবেশ করে সবার প্রথম যা নজর কাড়বে, তা হলো ‘জয়িতা-৭১’ ভাস্কর্য চত্বর। ঢাকা জেলা পরিষদের অর্থায়নে নান্দনিক কারুকার্যে ঘেরা এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন শিল্পী এহসানুল আহ্সান খান। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ এর শুভ উদ্বোধন করেন। ভাস্কর্যটিতে দেখা যায় দুজন নারী বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর্যের নিচের দেয়ালজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, এবং নারী আন্দোলনের চিত্রগুলোতে ভেসে আসে ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অগ্রণী ও প্রতিবাদী আন্দোলনের ঘটনাগুলো। এর চারপাশে সুবিস্তীর্ণ বাগান ও গাছপালা এর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। নিরাপত্তা ও ভাস্কর্য চত্বরের সৌন্দর্য রক্ষার্থে জায়গাটি সাধারণত বন্ধ থাকে। তবে বিশেষ দিনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, ভাস্কর্যটি আমাদের সেই সময়ের নারীসমাজকে মনে করিয়ে দেয় এবং এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।

জয় বাংলা, ভাস্কর: সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহান
জয় বাংলা, ভাস্কর: সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
যে আলো ছড়িয়ে যায় পুরো ক্যাম্পাসে
তন্বী পাল
বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সবুজে ঘেরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পাহাড়, মাঠ, বনের শোভা আর পাখির কিচিরমিচির শব্দে এই শিক্ষাঙ্গন মুখর থাকে সব সময়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানে ৫১ বছরেও ছিল না কোনো ভাস্কর্য। একটু দেরিতে হলেও অবশেষে সেই দুঃখ ঘুচেছে। ভাস্কর সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহান মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্বরের মধ্যবর্তী চৌরাস্তার মধ্যখানে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়।
‘লাইভ কাস্টিং মেথডে’, অর্থাৎ জীবিত মানুষের ছাঁচ তৈরি করে ভাস্কর্যটি বানানো হয়েছে। ধূসর রঙের আস্তরণে ব্যবহার করা হয়েছে মার্বেল ডাস্ট। ফলে রোদ–বৃষ্টিতেও মলিন হবে না ভাস্কর্যটি। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ ও সমান অংশগ্রহণ তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের ভূমিকা ও উপজাতি এক নারীর অবয়ব উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘জয় বাংলা’ কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং অন্যায়-অবিচার ও নির্যাতনকে পদদলিত করে বীর বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের এক সাহসী উচ্চারণ। ক্যাম্পাসে নির্মিত ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি যেকোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অনিবার্য সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল এটি। মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের দাবিতে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর এটি নির্মাণ করা হয়।
এখন প্রতিদিন বিকেলে ভাস্কর্যের সামনে বসে শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। রাতে ভাস্কর্যটি আলোকিত হয় নিয়ন বাতির আলোয়। এই আলো যেন ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্যাম্পাসে।

দুর্বার বাংলা, ভাস্কর: গোপাল চন্দ্র পাল
দুর্বার বাংলা, ভাস্কর: গোপাল চন্দ্র পাল

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
উদ্দীপনা জাগানোর মূলমন্ত্র
সুপ্রভা হক
ডিপার্টমেন্ট অব ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
১০১ একরের এই ক্যাম্পাসে যেকোনো আগন্তুকের চোখ আটকে যাবে দুর্বার বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যে। খুলনা শহর থেকে সাড়ে আট মাইল দূরে অবস্থিত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার পেরিয়ে কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে ডান দিকে প্রাণের সঞ্চারকারী এই দুর্বার বাংলা।
২০১৩ থেকে কুয়েটের বুকে জন্ম নেওয়া এই ভাস্কর্যের ভাস্কর গোপাল চন্দ্র পাল।
সন্ধ্যার পরই স্নিগ্ধ আলোয় ভেসে যায় ভাস্কর্য চত্বর। সামনে বিছানো পাথরে বসে চলে আড্ডা। মুহূর্তেই মুখরিত হয়ে ওঠে এই প্রাঙ্গণ। পাশের বহুতল একাডেমিক কমপ্লেক্স ভবন থেকে দুর্বার বাংলার আরেক সৌন্দর্য চোখে পড়ে।
দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেকের কাছে কুয়েটের প্রধান আকর্ষণ এই দুর্বার বাংলা। বিকেলের আলোয় নিবিড় হয়ে ওঠা এই দুর্বার বাংলা ক্লাস শেষে ক্লান্ত বিকেলের নতুন উদ্দীপনা জাগানোর মূলমন্ত্র। তাই এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের কাছে দুর্বার বাংলা এক ব্যতিক্রম জীবনীশক্তি।
ভাস্কর্যটি তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এটি আমাদের মধ্যে যে বার্তা দেয়, সেটি বহু পুরোনো। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে সংগ্রাম করেই। এই বেঁচে থাকার পেছনে যাঁদের অবদান, তাঁরা সব সময়ই আমাদের কাছে স্মরণীয়। আমরাও যেন তাঁদের মতো হতে চেষ্টা করি, সেই শক্তি দেয় এই ভাস্কর্য। আমাদের কানে কানে বলে যায়—অমর হও, চিরসবুজ হও।

বিজয়–৭১, ভাস্কর: শ্যামল চৌধুরী
বিজয়–৭১, ভাস্কর: শ্যামল চৌধুরী

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে মা-বাবারা সন্তানকে গল্প শোনান
মো. শফিকুল ইসলাম
কৃষি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের প্রতীক বিজয়-৭১। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্য। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বাঙালির যে একাত্মতা, ভাস্কর্যটির দিকে তাকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই দিকটিই সবার আগে চোখে ভাসবে। ক্যাম্পাসে প্রথমবার দেখার পর আমিও সেই ধারণা পেয়েছিলাম। প্রতিদিন অগণিত মানুষ ভাস্কর্যটি দেখতে আসেন।
প্রখ্যাত ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী সুনিপুণভাবে স্মারকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর্যটি, যা দুই অংশে বিভক্ত। মূল অংশে ছয় ফুট বেদির ওপর রয়েছে এক নারী, কৃষক ও ছাত্র-মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব। কৃষক মুক্তিযোদ্ধার হাতে শোভা পেয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। দৃষ্টি অসীম আকাশের দিকে। ডান পাশেই শাশ্বত বাংলার সর্বস্ব ত্যাগী ও সংগ্রামী এক নারীর প্রতিচ্ছবি। যেন দৃঢ়চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। আর ছাত্রের ডান হাতে রয়েছে গ্রেনেড ও বাঁ হাতে বন্দুক।
ভাস্কর্যটির গোড়ার দিকে টেরাকোটায় চিত্রিত হয়েছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফার দৃশ্য। এর সামনে দাঁড়িয়েই অনেক সময় শিশু-কিশোরদের যুদ্ধের গল্প শোনান মা-বাবারা। কিছুদিন আগেও এই ভাস্কর্যের পাদদেশে জন্ম নিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকেই একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বস্তরের জনগণ স্লোগান দিয়েছেন, মোমবাতি জ্বেলেছেন। ভাস্কর্যের চারপাশের খোলামেলা পরিবেশে অবসর কাটান শিক্ষার্থীরা। চলে গল্প, গান, কবিতা আবৃত্তি, আড্ডা ও ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। সব মিলিয়ে মনে হয়, এই ভাস্কর্য শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, তারুণ্যেরও প্রতীক।

মুক্তবাংলা, ভাস্কর: রশিদ আহমেদ
মুক্তবাংলা, ভাস্কর: রশিদ আহমেদ

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে
সাব্বির আহমেদ
বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত গল্পগুলোর স্মরণে এবং শহীদদের প্রতি মর্যাদার প্রতীক হয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তবাংলা। বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধের শৌর্য-বীরত্বের প্রতীক এই স্মারক। ১৯৯৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রশাসন ভবনের পূর্ব পাশে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
শিল্পী রশিদ আহমেদের নকশায় গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের এই মনোমুগ্ধকর প্রতীক—মুক্তবাংলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে মুক্তবাংলার মর্যাদা অন্য মাত্রায়। মুক্তবাংলা একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দেয়, অন্যদিকে বর্তমান শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষার্থীদের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে মুক্তবাংলার ইতিহাস ও সৌন্দর্য।