বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় বাড়ি : রিচার্ড ক্যাশ

খাওয়ার স্যালাইনের অন্যতম আবিষ্কারক রিচার্ড ক্যাশ। ছবি: সংগৃহীত
খাওয়ার স্যালাইনের অন্যতম আবিষ্কারক রিচার্ড ক্যাশ। ছবি: সংগৃহীত

‘১৯৬৭ সালের ঘটনা, তখন আমার বয়স ২৬ বছর। মেডিকেল স্কুল থেকে বের হয়ে মাত্র নিজের প্রশিক্ষণ শেষ করেছি। তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে। আমার বয়সী সবাইকেই যেতে হবে যুদ্ধে। কিন্তু আমি তো যুদ্ধে যেতে চাই না। জানতে পারলাম, ইউএস পাবলিক হেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে ডাক্তারদের পাঠানো হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। আমিও যুক্ত হয়ে গেলাম সেটায়। প্রথমে যখন বলা হলো, আমরা ঢাকা যাব, আমি ভাবলাম সেনেগালের রাজধানী ডাকারে পোস্টিং হবে আমাদের। পরে জানলাম, না, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের ঢাকা। অবশ্য তখন তো বাংলাদেশ বলত না, ইস্ট পাকিস্তান বলত।’

এটুকু বলে ভদ্রলোক একটু থামলেন। তাঁর নাম রিচার্ড ক্যাশ, ৭৮ বছর বয়সী এই চিকিৎসক বর্তমানে অধ্যাপনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ স্কুলে। তিনি ও তাঁর বন্ধু ডেভিড নেলিন খাওয়ার স্যালাইনের ফর্মুলার চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন, যা প্রাণঘাতী ডায়রিয়া থেকে রক্ষা করে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক মাস আগে রিচার্ড ক্যাশের সঙ্গে কথা হয় যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ ভবনে, তাঁর অফিসে। সেই অফিস সাজানো হয়েছে বাংলাদেশের দৃক গ্যালারি থেকে কেনা নানা রকম ছবি দিয়ে। বাংলাদেশের প্রতি মমতা শুধু তাঁর কণ্ঠে নয়, অফিসের সাজসজ্জাতেও স্পষ্ট! শুরু হয় আমাদের কথোপকথন—

কেমন লেগেছিল তখন, ঢাকাতে নেমে?

রিচার্ড ক্যাশ: সত্যি কথা বলতে কি, পা দিয়েই মনে হয়েছে, অকুপাইড একটা স্টেটে এসেছি। বাঙালিদের সমান মর্যাদা দেওয়া হতো না। তাদের সঙ্গে আচরণ করা হতো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের মতো। অথচ জানো, ওদের সঙ্গেই কিন্তু বেশি বনতো আমাদের। বাঙালি সহকর্মীরাও ছিল খুব পরিশ্রমী। মনে আছে, তখন আমেরিকান ক্লাব করা হয়েছিল একটি। কিন্তু বলা হয়েছিল, সেখানে শুধু আমেরিকানরা যাবে। আমরা তখন বলেছিলাম, বাঙালিরা না গেলে আমরাও যাব না।

বাংলাদেশে এসেই শুরু করেছিলেন কলেরা নিয়ে গবেষণা । কলেরার প্রতি মনোযোগ পড়ল কেন?

রিচার্ড ক্যাশ: আমরা এসেই কাজ শুরু করি কলেরা হাসপাতালে, বর্তমানে যা আইসিডিডিআরবি নামে পরিচিত। তখন প্রতি তিনজনে একজন শিশু মারা যাচ্ছিল ডায়রিয়াতে। ভয়ংকর পানিশূন্যতায়, হৃৎস্পন্দন (পালস) কমে যেত এবং দ্রুত গায়ের চামড়া হয়ে যেত শুকনো ও খসখসে। এমন অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মারা যাচ্ছিল রোগীরা। তখন যে চিকিৎসা ছিল, তা হচ্ছে আইভি দিয়ে স্যালাইন সলিউশন দেওয়া। অল্প কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া এই চিকিৎসা কোথাও দেওয়া সম্ভব ছিল না। হাসপাতালের সংখ্যাও এত কম ছিল যে দেখা যেত অনেক সময় আনার পথেই মারা যাচ্ছিল রোগীরা। কোনো গবেষণাতেই স্থানীয় এই সমস্যাগুলো উঠে আসত না। আমরা তাই ঠিক করলাম, ওরাল সলিউশন বের করার জন্য গবেষণা করব। যাতে রোগীর মুখে চিকিৎসাটি গ্রহণ করে ধীরে ধীরে সেরে উঠতে পারে। হাসপাতালের জন্য যাতে তাদের বসে থাকতে না হয়। বুঝতে হবে, তখন কিন্তু টিকাদানের হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ২৫০ জনের মতো! তাই চাইছিলাম এমন কিছু নিয়ে কাজ করতে, যা এই শিশুদের অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে। 

খুব কঠিন একটা কাজ শুরু করেছিলেন। আজ এতদিন পর,  প্রথম সাফল্যের কথা মনে আছে?

রিচার্ড ক্যাশ: অবশ্যই। ‘কলেরা বেড’ নামের একধরনের পাট আর কাঠ দিয়ে বানানো খাট ছিল, যাতে কলেরায় আক্রান্ত রোগীদের শোয়ানো হতো। এ রকম খাট এখনো আছে এবং কলেরা রোগীদের জন্য খুবই উপকারী! খাটের ঠিক মাঝখানে গর্ত থাকত এবং তার নিচে থাকত একটি বালতি। আমরা প্রতিদিন মাপতাম একজন রোগীকে মুখে কতটা পানীয় দেওয়া হচ্ছে এবং কতটা বের হয়ে যাচ্ছে তার শরীর থেকে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেল, লবণ তারা ধরে রাখতে না পারলেও গ্লুকোজ বা ভাতের মাড় তারা ঠিকই শরীরে ধরে রাখতে পারছে, বের হয়ে যাচ্ছে না। এমনকি খুব ভয়াবহ ধরনের কলেরায় আক্রান্ত রোগীদেরও মুখের এই সলিউশনের পাশাপাশি আগের চিকিৎসার তুলনায় ২০ শতাংশ আইভি স্যালাইন দিলেই সেরে উঠতে লাগল তারা। আমাদের সাফল্য দেখে ১৯৬৮ সালে কলেরা হাসপাতাল আমাদের অনুমতি দিল কুমিল্লার মতলবের হাসপাতালে এই চিকিৎসার প্রয়োগ করার। লক্ষ্য ছিল, দূর থেকে দূরান্তে এই চিকিৎসা ছড়িয়ে দিতে হবে। যাতে মূল শহরের হাসপাতালের ওপর মানুষের জীবন আর নির্ভর না করে। আমরা
খুব সফলতার সাথেই মতলবে
আমাদের চিকিৎসাটি প্রয়োগ করতে পারলাম। আমাদের সফলতার হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা নিঃসন্দেহে ছিল চমকপ্রদ।

খাবার স্যালাইন ডায়রিয়া নিরাময়ে আশীর্বাদ হয়ে আসে। ছবি: সংগৃহীত
খাবার স্যালাইন ডায়রিয়া নিরাময়ে আশীর্বাদ হয়ে আসে। ছবি: সংগৃহীত

প্রাথমিকভাবে তো সফল হলেন । চমৎকার ফলও এল। পরবর্তী চ্যালেঞ্জ কী ছিল?

রিচার্ড ক্যাশ: এরপরের চ্যালেঞ্জ ছিল একদম সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে এই চিকিৎসাটি পৌঁছানো। সে পর্যায়ে যেতে অবশ্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বেশ কিছুদিন। আমি ১৯৭০ সালে চলে এসেছিলাম আমেরিকায়। সে বছরই সাইক্লোনে আক্রান্ত হয় বাংলাদেশের মানুষ। আর এরপরের বছরই হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমি অবশ্য ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পরপরই আবার বাংলাদেশে যাই। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে। ইন্দিরা গান্ধী যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বাংলাদেশে দেখা করতে আসেন, তখন আমি সেখানে ছিলাম। সেবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম মূলত শরণার্থীশিবিরে কলেরার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কাজ করতে। তখনো যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই সরকারিভাবে আমেরিকা থেকে আইসিডিডিআরবিতে সব ধরনের সাহায্য আসা বন্ধ ছিল। আমরা কয়েকজন মিলে আমেরিকার বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশে ত্রাণ-সাহায্য পাঠাই। আমেরিকার কংগ্রেসের সামনে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্যও দিই, যাতে আমেরিকা স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ কারণে আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিদেশে জনমত তৈরির জন্য ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ পুরস্কার দেওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

তবে স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের এই ডায়রিয়ার চিকিৎসা একদম সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছাতে দারুণভাবে সক্ষম হয় ব্র্যাক। ফজলে হাসান আবেদ ও তাঁর সহকর্মীরা দারুণ সাফল্য পান ডায়রিয়ার চিকিৎসায়। আমরা নিজেরাও যুক্ত হই তাঁদের সঙ্গে। আমাদের ফর্মুলায় প্রথমে প্রয়োজন হতো এক লিটার পানির। ব্র্যাকের গবেষণায় সেটার পরিমাণ কমে হয় ৫০০ সিসিতে। এখনকার খাওয়ার স্যালাইনের যে রেডিমেড প্যাকেট থাকে, তা কিন্তু সেই ৫০০ সিসির পানিতে মেশানোর জন্যই। ব্র্যাকের গবেষণায় আরও উঠে আসে যে ঘরে থাকা এক মুঠো খাওয়ার গুড় ও এক চিমটি খাওয়ার লবণ দিয়েই আমাদের ফর্মুলাটি তৈরি করা সম্ভব। ব্র্যাক থেকে তখন প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হলো তরুণ–তরুণীদের, যাঁদের বলা হতো, ‘ওরাল থেরাপি ওয়ার্কার’। এঁদের কাজই ছিল বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে প্রতিটি বসতবাড়িতে গিয়ে খাওয়ার স্যালাইনের এই ফর্মুলা মানুষকে শেখানো। এখন গুড় ও লবণের পরিমাণ নাহয় বোঝা গেল সহজে। কিন্তু ৫০০ সিসির পানির সঠিক পরিমাণ কীভাবে বোঝানো হতো? ব্র্যাকের এই মাঠকর্মীরা নিজেরা একটি করে ৫০০ সিসির পাত্র নিয়ে যেত প্রতিটি বাসায়। এরপর বাসার গৃহকর্ত্রী বা কর্তাকে বলতেন, বাসায় থাকা পানির জগ বা পাত্র নিয়ে আসতে। নিজেদের ৫০০ সিসি পাত্রে পানি ভরে মাঠকর্মীরা ঢেলে দিতেন বাসায় থাকা পানি রাখার পাত্রে। যত দূর ভরত, তা একটা মার্কার কলম দিয়ে দাগ দিয়ে দিতেন। ব্যস, এভাবেই সবার বাসায় পানি মাপার পাত্রও রেডি হয়ে গেল। একদম গ্রাম পর্যায়ে ডায়রিয়া প্রতিরোধে আর কোনো বাধাই থাকল না।

কী চমৎকার রূপকথার মতো একটি গল্প! এখন কি বাংলাদেশে যান? বাংলাদেশের কোন পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে?

রিচার্ড ক্যাশ: কী আশ্চর্য, কেন যাব না? বাংলাদেশ তো আমার দ্বিতীয় বাড়ি (সেকেন্ড হোম)। প্রতিবছর যাই, অনেকটা সময় কাটাই। বাংলাদেশের কি চমৎকার উন্নতিই না হয়েছে। টিকাদানের হার ৯০-৯৫ শতাংশ, শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে নেমে এসেছে মাত্র ৩০–এর ঘরে! এই পরিসংখ্যানই তো বলে দেয় বাংলাদেশের সাফল্য। ২০০৭ সালে একবার কলেরা আউটব্রেক হলো ঢাকাতে। দিনে গড়ে ১ হাজার ৬০০ জন রোগী আসত আইসিডিডিআরবিতে। বিশ্বাস করো, এমন রোগীর ঢল নামলে আমাদের বোস্টনের হাসপাতালও সামলাতে পারত না। ঢাকা ঠিকই সামলাল। এগুলো তো উন্নয়নেরই লক্ষণ, তাই না?

গত বছর খাওয়ার স্যালাইনের এই ফর্মুলা আবিষ্কারের ৫০বছর পূর্তি হলো । কাগজকলমে কম করে ধরলেও কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন সারা পৃথিবীতে? কেমন লাগে চিন্তা করলে?

রিচার্ড ক্যাশ: (একটু হেসে) লোকে বলে এমন কথা। আমার ও রকম করে চিন্তা করা হয় না। তবে হ্যাঁ, একধরনের সন্তুষ্টি তো কাজ করেই, ভালো লাগে।

মজার কোনো ঘটনা শোনান না, তখনকার বাংলাদেশের কোনো অভিজ্ঞতা?

রিচার্ড ক্যাশ: তাহলে শোনাই, ঢাকায় থাকার প্রথম রাতের গল্প। ঘরের দরজা–জানালা লাগিয়ে রাতে শুয়েছি। হঠাৎ শুনি কে যেন কাশছে! কেশে, গলা পরিষ্কার করে, থুতুও ফেলছে। আমি তো প্রথমে ভয়ে শেষ। পরে সাহস করে ঘরের আলো জ্বালানোর পর দেখলাম ঘরে কেউ নেই—একমাত্র বাড়িওয়ালার রেখে যাওয়া পোষা ময়না পাখিটা ছাড়া। আমাকে তখন অবাক করে দিয়ে ময়না পাখিটাই অবিকল মানুষের মতো করে কেশে, গলা পরিষ্কার করে, থুতু ফেলার শব্দ করল। পরে জেনেছিলাম, আগের ভাড়াটের কাছে শিখেছে। আমি অবশ্য সেই পাখিটিকে রাখিনি। কে আর সারা দিন কাজের শেষে বাসায় এসে পাখির কাশি শুনতে চায় বলো?

লেখক: চলচ্চিত্রকার ও অ্যানিমেটর