অস্ট্রেলিয়ায় তরুণ ধনীর তালিকায় আশিক

প্রযুক্তি উদ্যোক্তা আশিক আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ তরুণ ধনীদের একজন। ছবি: সংগৃহীত
প্রযুক্তি উদ্যোক্তা আশিক আহমেদ অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ তরুণ ধনীদের একজন। ছবি: সংগৃহীত
গত অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার দৈনিক পত্রিকা অস্ট্রেলিয়ানফিন্যান্সিয়ালরিভিউ দেশটির শীর্ষ ১০৩ তরুণ ধনীর তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকার ২৫ নম্বরে থাকা নামটি হলো আশিক আহমেদ। ১৬ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানো বাংলাদেশের আশিক আহমেদ কম্পিউটার সফটওয়্যার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, হয়েছেন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। ডেপুটি নামের একটি সফটওয়্যার উদ্যোগই তাঁকে নিয়ে এসেছে শীর্ষ ধনীর তালিকায়। আশিক আহমেদকে নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

মাসখানেক আগের কথা। অস্ট্রেলিয়ায় হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক তরুণ। তিনি অস্ট্রেলিয়ার তরুণ শীর্ষ ধনীদের একজন। কে তিনি, কীভাবে, কী কারণে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ ধনী—এ নিয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়ে গেল দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমের। কথা বলতে বলতে যখন হাঁপিয়ে উঠেছেন, তখনই আবার আমাদের সঙ্গে কথা। নিজের টানেই বলে গেছেন তাঁর বাংলাদেশের গল্প, বেড়ে ওঠা, অস্ট্রেলিয়ার জীবন এবং ব্যবসা করার গল্প। এই তরুণের নাম আশিক আহমেদ। ১৬ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন মা-বাবার সঙ্গে। এখন তিনি প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। ‘ডেপুটি’ নামের সফটওয়্যার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও সহপ্রতিষ্ঠাতা। স্ত্রী মুশফিকা আহমেদ ও দুই ছেলে আইদিন ও অ্যারনকে নিয়ে সিডনিতেই বসবাস করেন তিনি।

গত অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসা ও অর্থবিষয়ক দৈনিক পত্রিকাঅস্ট্রেলিয়ানফিন্যান্সিয়ালরিভিউ দেশটির শীর্ষ ১০৩ তরুণ ধনীর তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় উঠে আসে আশিক আহমেদের নাম। সম্পদের হিসাবে তাঁর অবস্থান ২৫তম। পরিসংখ্যান বলে, অস্ট্রেলিয়ায় আশিকের সম্পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে আশিকের বয়স ৩৮ বছর। তাঁর সঙ্গে কথা হয় সিডনির একটি হোটেলে। আলাপনের শুরুতেই বললেন, ‘আমি শুধু অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে কখনোই কাজ করিনি। সমস্যার সমাধানই ছিল আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।’

স্ত্রী মুশফিকা আহমেদ ও দুই ছেলের সঙ্গে আশিক আহমেদ
স্ত্রী মুশফিকা আহমেদ ও দুই ছেলের সঙ্গে আশিক আহমেদ

সফটওয়্যার তৈরির পেছনে যে গল্প রয়েছে, সে কথা বলার আগে বললেন, ‘গল্পটা একটু ঠিক করতে হবে। কোথাও কোথাও লেখা হয়েছে আমি ফাস্টফুড শপে কাজ করতাম, সেখান থেকে সফটওয়্যার বানাতে শুরু করি। কিন্তু বিষয়টি ঠিক এ রকম নয়। আমি বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার মাত্র চার দিন পরেই ছোট ভাইসহ মা-বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলে আসি।’

অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় সব ছাত্রছাত্রী যেমন করে, তেমনি আশিকও হাংরি জেক্স নামের ফাস্টফুড চেইন শপে কাজ করেন। বললেন, ‘কিন্তু সেখান থেকেই সফটওয়্যার বানাতে শুরু করি এমন নয়। আমি এখানে আসার পর আবার ক্লাস টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করি।’

আশিক একটা সময় ঘণ্টাভিত্তিক বেতনে কাজ করতেন। দেখতেন, হিসাব রাখার পদ্ধতিটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ। এটি ঠিক না করতে পেরে অনেক সমস্যায় পড়েন কর্মীরা। মালিকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ সমস্যা সমাধানের একটি সহজ সমাধান খুঁজতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান দিয়ে তিনি ২০০৮ সালে তৈরি করেন ‘ডেপুটি’ নামের সফটওয়্যার। অস্ট্রেলীয় স্টিভ শ্যালিকে সঙ্গে নিয়েই ডেপুটি নামের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু। ধীরে ধীরে ব্যাপক সাড়া পেতে শুরু করে আশিকদের সফটওয়্যারটি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে ১ লাখ ৮৪ হাজার প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যারটি ব্যবহার করছে। এই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বিমান সংস্থা কোয়ান্টাস।

শীর্ষ ধনীর তালিকায় আপনার নাম এল, কেমন লাগছে? আশিক আহমেদের জবাব, ‘হঠাৎ এই ধনীর তালিকায় আমার নাম ওঠায় কিছুই যায়–আসে না। তালিকায় আমি থাকি বা না থাকি, প্রতিদিন সকালে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি ঘুম থেকে উঠি, তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।’

যা শেখার তা বাংলাদেশেই

আশিক আহমেদের জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায়। অন্যদের জীবনকে সমৃদ্ধ করার মধ্যেই নিজের সার্থকতা খুঁজে পান তিনি। বললেন, ‘আমার জীবন ধন্য হবে, যদি আমাকে দেখে বাংলাদেশের কেউ উৎসাহিত হয়। জীবনে যতটুকুই সফল হয়েছি বা ভবিষ্যতে হব, তার জন্য যতটুকুই শিক্ষা পেয়েছি, তা বাংলাদেশেই শিখেছি। আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে পড়ালেখা করেছি। জীবনে হয়তো অনেক কঠিন সময় আসবে কিন্তু মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সপ্তম শ্রেণির মতো কঠিন সময় মনে হয় আর আসবে না। ওই সময়টুকুতে যা শিখেছি, সেটাই আমার জীবনের সেরা শেখা।’

অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে
অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে

ধনসম্পদ কখনো জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়
আশিক আহমেদ কখনো সংখ্যা যোগ করেন না। ২৫তম তরুণ ধনী নাকি অন্য কিছু, সেটা নিয়েও ভাবেন না কখনোই। তাঁর মতে, টাকাপয়সা, ধনসম্পদ—এগুলো কখনোই কারও জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। বললেন, ‘কারণ, এটা যখন হয়, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, মানুষ তখন দুর্নীতিগ্রস্ত হবে। এটা বাংলাদেশে হোক আর অন্য কোনো দেশেই। টাকাপয়সা লক্ষ্য হলে নীতি–নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হয়। আপনি কী করতে চান, সেটা করুন—যদি হয়, তাহলে টাকাপয়সা এমনি এমনি হবে।’

প্রযুক্তিবিদ হবেন ভাবেননি কখনো

আশিক আহমেদ প্রযুক্তিবিদ হবেন, এমনটি ভাবেননি। বাংলাদেশ থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল গণিতের প্রতি। সে কারণেই প্রযুক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। প্রথমে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে খুব উৎসাহ ছিল তাঁর। আশিক বলে যান, ‘প্লেন-রকেট নিয়ে কাজ করব। কিন্তু যখন শুরু করি, তখন দেখি আমার কাছে বিষয়টি বোরিং মনে হচ্ছে। মনে হলো এটাতে আমি ভালো করতে পারব না। এরপর রোবটিকস শুরু করলাম।’ এক বছর পড়ার পর আশিক বুঝলেন যন্ত্র প্রকৌশলও তাঁর ভালো লাগছে না। এরপর দেখলেন, সমস্যার সমাধান করতে তাঁর ভালো লাগে। ‘সফটওয়্যার, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে আসলেই অনেক সুযোগ আছে সমস্যার সমাধান করার। সেভাবেই আমি সফটওয়্যার জগতে নেমে পড়লাম।’

ভালো একটি ব্যবসা খুবই সহজ

যাঁরা এ ধরনের ব্যবসা করতে চান, তাঁদের জন্য সহজ সূত্র দিলেন আশিক আহমেদ। তাঁর মতে, ভালো কিংবা বিরাট একটি ব্যবসা করার সূত্র খুবই সহজ এবং সাধারণ। এ, বি ও সি টাইপের সমন্বয়। ‘এ’ হলো অনন্য কিছু করা, ‘বি’ হলো মানুষের কাজে লাগে এমন কিছু করা, আর ‘সি’ হলো বেশি করে খোঁজা, কাদের কাজে লাগে। এই তিনটি মেলাতে পারলেই একটি দুর্দান্ত ব্যবসা হয়ে যেতে পারে।

পড়াশোনা ও পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই

অস্ট্রেলিয়া অভিবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই ভালো জায়গা। নিজের মেধা কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ সুযোগ এখানে রয়েছে। আশিক বললেন, ‘কাজ করার জন্য এ দেশটি অতুলনীয়। যাঁরা বাংলাদেশে রয়েছেন, তাঁদের বলব পড়াশোনা ও কঠোর পরিশ্রম করতে। কারণ, এর কোনো বিকল্প নেই। সময়, মেধা, শক্তি এবং ভাগ্য একটা সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’