নারীদের লেপ সেলাইয়ের গ্রাম

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বোয়ালখালী (সদর) ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শ নগর গ্রাম। গ্রামটি ‘কাদের শিবির’ নামেই বেশি পরিচিত। গ্রামে আড়াই শতাধিক পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের নারীরা চার মাস ব্যস্ত থাকেন লেপ সেলাইয়ের কাজে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গৃহস্থালির কাজকর্ম সেরে বেলা দেড়টা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত লেপ সেলাই করেন। প্রতিদিন নারীরা তৈরি করেন পাঁচ শতাধিক লেপ।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা লেপ সেলাইয়ের উপকরণ সরবরাহ করে নারীদের দিয়ে লেপ সেলাই করান। প্রতিটি লেপ সেলাইয়ে মজুরি হিসেবে দেওয়া হয় ৮৫ টাকা।

 একসময় এই গ্রামের মানুষ অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে তা সময়মতো ফেরত দিতে পারতেন না। তবে এখন গ্রামের চেহারা পাল্টে গেছে। গত ৯ বছর লেপ সেলাই করা নারীরাই পাল্টে দিয়েছেন গ্রামের চিত্র। দুই শতাধিক নারী লেপ সেলাই করেন।

 লেপ সেলাই করেও আয় করা যায় এই পথটি প্রথম দেখান রহিমা বেগম। রহিমা ২০০৬ সালে মাত্র সাতজন নারীকে নিয়ে চুক্তিতে লেপ সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। এখন দুই শতাধিক নারী লেপ সেলাইয়ের কাজে জড়িত। বাংলা আশ্বিন মাসের শুরুতে গ্রামের প্রতিটি ঘরের উঠানে চোখে পড়বে নারীদের লেপ সেলাইয়ের দৃশ্য। পৌষ মাস পর্যন্ত নারীরা এই কাজ করেন।

লেপ সেলাইয়ে ব্যস্ত সুফিয়া বেগম। ছবি: পলাশ বড়ুয়া
লেপ সেলাইয়ে ব্যস্ত সুফিয়া বেগম। ছবি: পলাশ বড়ুয়া

গ্রামে ঢুকে রহিমা বেগমের (৩৮) বাড়ির উঠানে দেখা গেল কয়েকজন নারী লেপ সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত। নারীরা জানালেন, লেপ সেলাই করে একেকজন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। গ্রাম ঘুরে দেখা গেল বিভিন্ন বাড়ির উঠানে তুলার বস্তা ও লেপ সেলাইয়ের জন্য লালসালু কাপড়ের স্তূপ রাখা।

 হাসিনা বেগম (২০) লেপ সেলাই করতে করতে জানালেন, গত তিন বছর তিনি লেপ সেলাই করছেন। প্রতিদিন দুটি লেপ সেলাই করতে পারেন। লেপ সেলাইয়ের জন্য তুলাধোনা করার কাজে ব্যস্ত ইয়াসমিন বেগম (৩২) বললেন, তিনি প্রতিদিন প্রায় পাঁচটি লেপ সেলাই করতে পারেন। পাঁচ বছর ধরে এ কাজ করছেন।

লেপ সেলাইয়ের জন্য তুলাধুনার কাজ চলছে। ছবি: পলাশ বড়ুয়া
লেপ সেলাইয়ের জন্য তুলাধুনার কাজ চলছে। ছবি: পলাশ বড়ুয়া

রমিজা বেগমের (২৫) স্বামী দিনমজুর। দুই মেয়ের একজন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। প্রতিদিন দুটি লেপ সেলাই করে সংসারের বিভিন্ন খরচে সহায়তা করেন। সমেলা খাতুন (৬৫) নিজে আর ছেলের বউ মিলে লেপ সেলাই করেন। বললেন, অবসর সময়ে বসে না থেকে লেপ সেলাই করে সময় কাটে, পাশাপাশি আয়ও হয়।

 বোয়ালখালী নতুন বাজারের পাইকারি লেপ ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম বললেন, ‘কাদের শিবিরের নারীদের দিয়ে আমি প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার লেপ সেলাই করাই। এ লেপ আমি পাইকারি হিসেবে বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি করি।’

ব্যবসায়ী আহাম্মদ হোসেন চলতি বছর এই গ্রামের নারীদের দিয়ে ৯০০ লেপ সেলাই করিয়েছেন। তাঁর মতে, এই গ্রামের নারীদের লেপ সেলাইয়ের কাজ নিখুঁত ও সুন্দর হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় লেপের চাহিদা রয়েছে।

 ব্যবসায়ী নবী হোসেন জানালেন, পাহাড়ি এলাকায় একটু আগাম শীত পড়ে। তাই আশ্বিন মাসের শুরুর দিকেই গ্রামের নারীরা লেপ সেলাইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নারীদের বানানো লেপ রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, লংগদু উপজেলা, খাগড়াছড়ি সদর, মহালছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় পাইকারি বিক্রি করা হয়। প্রতিটি লেপ প্রকারভেদে সাড়ে ৩০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করা হয়।

 উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান সীমা দেওয়ান বললেন, ‘এই গ্রামের নারীরা লেপ সেলাই করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হচ্ছেন। নারীরা অবসরে গল্পগুজব না করে কাজ করছেন। এই গ্রামের নারীদের দেখে অন্যান্য গ্রামের নারীরাও অনুপ্রাণিত হবেন।’