রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩% বহুদূরে

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

নির্বাচনী আইন বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সব কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী থাকতে হবে। এই শর্ত মানার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে বড়জোর এক বছর সময় আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে নির্ধারিতসংখ্যক নারী থাকবে কি না, তা নিয়ে দলগুলোই সংশয়ে আছে।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ২০–২১ ডিসেম্বর হয়েছে, তবে এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। অন্যদিকে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিএনপির পরবর্তী কাউন্সিল চলতি বছরেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, আগামী বছর কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যান্য দলের মধ্যে গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কাউন্সিল আগেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় পার্টির কাউন্সিলও হবে ২৮ ডিসেম্বর। কমিশনে নিবন্ধিত প্রধান প্রধান এই দলগুলোর কমিটির দিকে তাকালে এখন পর্যন্ত ৩৩ শতাংশ নারী থাকার বাধ্যবাধকতা পূরণে তাঁদের সদিচ্ছা তেমনটা দেখা যায় না।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০২০) বলা হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ১৫৩টি দেশের মধ্যে ৫০তম স্থানে। যে বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এই প্রতিবেদন করা হয়েছে, তার মধ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি। এখানে দেখা হয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে কতজন নারী আছেন, সংসদে কতজন আছেন, রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে নারী কত দিন ক্ষমতায় আছেন। এই তিনটি ক্ষেত্রে নারীর অবস্থানে দেখা যাচ্ছে, গত ৫০ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৬ বছর সরকারপ্রধান নারী। যা বিশ্বে রেকর্ড। সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনসহ ওই সময় সংসদে নারী ৭১ জন। অবশ্য মন্ত্রিপরিষদে নারীর সংখ্যার দিকে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়ে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান ততটা ভালো নয়। গত সরকারে ছিলেন ৫ জন, এবারও তাই। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক দলে নারীর অবস্থান এখনো অনেক কম। যদিও প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পদে আছেন নারী। জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন একজন নারী।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। বিশ্বব্যাপী তাঁর নেতৃত্ব এখন স্বীকৃত। ইতিহাসেও বিরল যে একজন নারী সরকার প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘নারী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি এই নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে নারীর পদচারণ এখন দৃশ্যমান। কিন্তু তারপরও আমরা দেখি আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ন্যূনতম এক–তৃতীয়াংশ নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। সেটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।’

কোন দলে নারীর কী অবস্থা

রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলে নারীরা দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন, এটাই ছিল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইন করা লক্ষ্য। রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরে ২০২০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করার পেছনে রাজনীতিতে নারীর দৃশ্যমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য ছিল।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপিতমণ্ডলীর সদস্য পদে চারজন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটিতে রয়েছেন দুজন নারী। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে দুজন মাত্র নারী আছেন। ৭৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদে মাত্র ছয়জন নারী রয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে একজনও নারী নেই। অন্যদিকে বিএনপিতে একই পদে ১০ জনের বিপরীতে নারী আছেন মাত্র দুজন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে চারজনের বিপরীতে নারী মাত্র একজন। কিন্তু বিএনপিতে একই পদে কোনো নারী সদস্য নেই। ৮১ সদস্য নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে নারী ছিলেন মাত্র ১৫ জন। বিএনপির ৫০২ সদস্যের বর্তমান কমিটিতে নারী আছেন ৬৫ জন।

গত বছর দলে এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান জানতে চেয়ে ইসির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়। ৪০টি দলের মধ্যে ১০টি দল নারী নেতৃত্বের বিষয়ে দলের কী অবস্থান, তা ইসিকে জানায়। এর মধ্যে একটিমাত্র দল গণফ্রন্ট তাদের নেতৃত্বে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি আনতে পেরেছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বিদায়ী কমিটিতে ৮১ জনের মধ্যে ১৫ জন ছিলেন নারী; শতকরা তা ১৮ শতাংশ। বিএনপির সব স্তরের কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন। আর জাতীয় পার্টির সব পর্যায়ের কমিটিতে নারী রয়েছেন ২০ শতাংশ।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বললেন, সবাই চায় দলে নারী নেতৃত্ব বাড়ুক। মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের আইনি বাধ্যবাধকতা তো আছেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনে করেন, নারীরা রাজনীতিতে এখন আগের তুলনায় বেশি সক্রিয় হচ্ছেন। কিন্তু নানা কারণে এই সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। সামাজিক নানা সমস্যা রয়েছে, এটাও বুঝতে হবে। তারপরও বিএনপির কমিটিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। এটা অব্যাহত থাকবে।

প্রধান দুই দলে নারী নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা

আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের প্রধান দুই পদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক পদে একজন নারীকে নির্বাচিত করা হয়েছে।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেছেন, নারীরা রাজনীতিতে সামনের কাতারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলের কমিটিতে নারীর সংখ্যা বাড়বে।

 বিএনপিতে নারী নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা চলছে। এবারই প্রথমবারের মতো দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পদে একজন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে আছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতা আফরোজা আব্বাস। এ ছাড়া দলের রাজনীতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিপুণ রায় চৌধুরী। তাঁকে দলের ওপরের দিকের নেতৃত্বে নেওয়ার কথা ভাবছে দল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান মনে করেন, নারীদের জায়গা দিতে হবে। নারীরা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে এলে রাজনীতির চেহারা পাল্টাবে, ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সংগঠনটির সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, ২০২০ সালের মধ্যে কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রাখার ব্যাপারে দলগুলো ততটা তৎপর নয়। তবে এ–ও ঠিক বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। ২০২০ সাল গুরুত্বপূর্ণ। সময়ই বলে দেবে দলগুলো কী করবে। তিনি বলেন, কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী ২০২০ সালের মধ্যে রাখা বাধ্যতামূলক। তা না হলে কমিশন নিবন্ধন বাতিলসহ যেকোনো ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট দলের বিরুদ্ধে নিতে পারে।