'ভয় পেয়ো না মা, বিষয়টি স্বাভাবিক'

একদিন দুপুরে বাথরুমে গিয়ে দেখলাম, আমার হাফপ্যান্টে রক্ত। আমি তখন সবে ১২। পিরিয়ড বা মাসিক সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ভয় পেয়ে মাকে বললে তিনি আমার চেয়েও বেশি ভয় পেলেন। সবার অগোচরে ঘরে নিয়ে গিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে একটা ন্যাকড়া দড়িটার এপাশ-ওপাশ করে আটকে দিলেন। ব্যস এতটুকু। অন্যদিকে ওই রক্ত নিয়ে আমার মনে হাজার প্রশ্ন।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমার নিজের মাও হয়তো জানতেন না মাসিক নিয়ে সন্তানকে কী শেখাতে হবে! ফলে প্রশ্নগুলো মনে রেখেই প্রথম ঋতুস্রাবের দিনগুলো পার হলো। এরপর মাসের সাতটি দিন, তলপেটে ব্যথা, সবার চোখের আড়ালে ন্যাকড়াটা শুকাতে দেওয়া, মাসিক নিয়ে বাবা-ভাইদের সঙ্গে আলোচনা না করা—এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় ঘটতে থাকল। খুব যত্ন করে ‘ভীষণ লজ্জার’ এই সময় গোপন করেছি বহু বছর।

আমি রুখসানা মিলি, একজন কর্মজীবী মা। আমার মেয়ের বয়স এখন প্রায় ১২। ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে মেয়েদের প্রথম মাসিক শুরু হয়। ওর জন্য সামনের যেকোনো একটা দিন প্রথম ঋতুস্রাবের দিন হবে। তখন ও হয়তো স্কুলে থাকতে পারে বা অন্য কোথাও। প্রথম রক্তের ফোঁটা ওর জন্য যাতে কোনো ভীতি তৈরি না করতে পারে, তাই আমি ওকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছি।

প্রতি মাসে মেয়েদের এমন একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়, সে কথা জানিয়ে রেখেছি। স্যানিটারি প্যাড কী, কেন ব্যবহার করতে হয়—এ বিষয়ও ওর জানা। আর সবচেয়ে বড় অভয় দিয়ে বলেছি, ‘যদি হঠাৎ স্কুলে বা অন্য কোথাও এমন কিছু দেখো, ভয় পেয়ো না মা, বিষয়টি স্বাভাবিক।’

আমি আমার মেয়েকে মাসিক নিয়ে প্রস্তুত করলেও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত ২০১৪ সালের এক গবেষণা বলছে, কিশোরী ও বয়স্কদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মাসিক হওয়ার আগেই এ সম্পর্কে জানতে পেরেছে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সফটকলের সাইকোলজিস্ট জাকিয়া সুলতানা বললেন, মাসিকের শুরুতেই মেয়ে যেন আতঙ্ক ও দ্বিধাগ্রস্ত না হয়, তাই প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত মাসিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে রাখা।

স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ে যত ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানিয়ে রাখতে হবে। মাসিক হলে কেবল মাকে বা পরিবারের নারী সদস্যদের বলা যাবে, বাবার সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না বা বাবাকে ন্যাপকিন কিনতে বলা যাবে না, এমন ধারণা থেকে সন্তানকে বের করে আনতে হবে।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন নাজমা খাতুন বললেন, মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও জানানো জরুরি। বিষয়টি যে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক, তা শুরু থেকেই কিশোর-কিশোরীদের অভ্যস্ত করতে হবে।

বিআরবি হাসপাতালের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ শাহিনা বেগম বললেন, শারীরিক এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হাইজিন বা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা প্রতিটি মেয়ের জন্য খুব জরুরি। মাসিকের সময় অপরিচ্ছন্ন থাকলে নানান স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। শারীরিক পরিবর্তনের এই সময়ে মেয়েকে পুষ্টিকর ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে।

আমি নিজে মাসিক নিয়ে আগে থেকে সচেতন ছিলাম না বা সে উপায়ও ছিল না। আমার মেয়ে তার বয়স অনুযায়ী সচেতন, তাই মাসিক নিয়ে মেয়ের মধ্যে কোনো ধরনের ভয় কাজ করবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

রুখসানা মিলি: কর্মজীবী মা