স্বামীর পকেটে পাওয়া একটি রসিদ...

কারখানায় কাজ দেখছেন সাবিনা শেখ (ডানে)।  ছবি: শহীদুল ইসলাম
কারখানায় কাজ দেখছেন সাবিনা শেখ (ডানে)। ছবি: শহীদুল ইসলাম

সাবিনা শেখের বয়স তখন মাত্র ৩১ বছর। এক কন্যা ও মুঠোফোনে ২০৮ টাকা ব্যালান্স রেখে স্বামী মাজদার রহমান মারা গেলেন। স্বামীর পকেটে পাওয়া গেল এক টুকরো কাগজ। একটি পোশাক কারখানার নামে একটি রসিদ ছিল সেই কাগজ। কাগজ দেখে সাবিনার কিছুই মাথায় আসে না।

একদিন স্বামীর মুঠোফোনটি বেজে উঠলে ওপাশ থেকে খুলনা ক্যান্টনমেন্টের একজন সেনা কর্মকর্তা কথা বললেন। কথা শুনে সাবিনা চমকে গেলেন। তাঁর স্বামী নাকি ওই ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকদের ৪ লাখ টাকার ট্র্যাকস্যুট আর গেঞ্জি সরবরাহের বায়না নিয়েছিলেন। কত তারিখের মধ্যে মাল সরবরাহ করতে হবে, তা–ও বলে দিলেন ওই সেনা কর্মকর্তা। তাঁকে বিশ্বাস করানোই যাচ্ছিল না যে তাঁর স্বামী মারা গেছেন।

স্বামী মারা গেলেও ততটা ভেঙে পড়েননি, যতটা ভেঙে পড়লেন সেনা কর্মকর্তার কথা শুনে। তবে স্বামীর পকেটের সেই রসিদের সূত্রেই সাবিনা এখন অসহায় মানুষের কান্ডারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সাবিনা স্বামীর পকেটে পাওয়া কাগজের টুকরাটি মিলিয়ে দেখলেন সেটিই ওই ক্যান্টনমেন্টের ফরমাশের রসিদ। ঢাকার আবদুল্লাহপুরে সেই পোশাক কারখানায় সেই মালের ফরমাশ দেওয়া রয়েছে। সাবিনা সেই কারখানায় খবর নিতে লাগলেন। খবর পেলেন কিছু টাকা পরিশোধের বাকি রয়েছে। সাবিনার কাছে টাকা নেই। সাহস করে কিছু টাকা ধার করলেন। কারখানা থেকে মাল তুলে খুলনায় সরবরাহ করলেন সাবিনা।

সাবিনার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প আজ অনেকের জীবনের অনুপ্রেরণার উৎস। সাবিনা এখন নিজেই একটি পোশাকশিল্প কারখানার মালিক। দুটো বাড়ি বানিয়েছেন, কিনেছেন আরও একটি। তাঁর এখন আর দম ফেলার সময় নেই। সারা দেশেই তাঁর বাজার। অসহায় নারীরা এখন তাঁর কারখানার কর্মী।

তবে শুধু নারী নন, পুরুষ কর্মীরাও কাজ করছেন কারখানায়। কর্মীরা ৮ হাজার থেকে শুরু করে অতিরিক্ত সময় কাজ করে মাসে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন তুলছেন। এই কর্মীরাও ঘরবাড়ি বানিয়েছেন, জমি কিনেছেন। এমনকি ঢাকা থেকে ফিরে এসে অনেকেই সাবিনার কারখানায় কাজ করছেন। আবার কাজ শিখে বের হয়ে গিয়ে অনেকেই নিজে কারখানা করেছেন। সাবিনার দেখানো পথে এখন অনেকেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।

সাবিনার কারখানাটি রাজশাহীর পবা উপজেলার চকবেলঘরিয়া বাখরাবাজ গ্রামে। সিনথিয়া সাবিনার একমাত্র মেয়ের নাম। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ করছেন। ‘সিনথিয়া ভিলা’ নামে একটি দোতলা ভবনের কারখানাটির মালিক এখন সাবিনা। সম্প্রতি সাবিনার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সিনথিয়া ভিলার নিচতলায় এক পাশে কারখানা আরেক পাশে তৈরি মালের গুদাম। আরেক পাশে কাপড়ের গুদাম। আর দোতলায় তাঁর অফিশিয়াল কার্যক্রম চলছে।

 সাবিনার নামের আদ্যক্ষর ‘স’ আর তাঁর স্বামী মাজদার রহমানের নামের আদ্যক্ষর ‘ম’ এই দুটো অক্ষর দিয়ে সাবিনার স্বামী তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন ‘সমফ্যাশন’। কাগজে-কলমে এই প্রতিষ্ঠানের নামে মাজদার রহমান দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট, কারাগার, পুলিশ একাডেমিসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে ট্র্যাকস্যুট, জার্সি, গেঞ্জি, পায়জামা, টি-শার্ট, ফতুয়া ইত্যাদি সরবরাহের কাজ করতেন। তাঁর নিজের কোনো কারখানা ছিল না। তিনি ফরমাশ পেলে অন্য কারখানা থেকে পোশাক তৈরি করে ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর আগে সাবিনা শুধু এটুকু জানতেন।

সাবিনা শেখ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিও পার হতে পারেননি। বাংলা পড়তে পারেন। নাম সই করতে পারেন। এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েই তিনি সারা দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন। নিজেই নিয়মিত আয়কর পরিশোধ করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন আবার পরিশোধ করছেন। তাঁর রয়েছে অদম্য মানসিক শক্তি। সারা দেশের ক্যান্টনমেন্টগুলোর ঠিকানা তাঁর মুখস্থ। সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলাও শিখে গেছেন। তাঁর কারখানায় পুলিশ, সেনাসদস্য, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ব্যায়ামের বিভিন্ন পোশাক, জার্সিসহ বিভিন্ন ফরমায়েশি পণ্য তৈরি করছেন।

সাবিনার কারখানায় কাজ করছিলেন সাম্মী আক্তার। তিনি দুই বছর ধরে সাবিনার কারখানায় কাজ করছেন। বললেন, তিনি এই কারখানা থেকে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন তোলেন।

উজ্জ্বল হোসেন (২৫) সাড়ে তিন বছর ধরে সাবিনার কারখানায় কাজ করছেন। তিনি ঢাকার কাজ ছেড়ে এসে এই কারখানায় কাজ নিয়েছেন। তাঁর মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। তিনি বললেন, অতিরিক্ত সময় কাজ করে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন তুলেছেন।

সাবিনা শেখ বললেন, ২৩ জন ছেলে–মেয়ে কারখানায় কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন অস্থায়ী। বেশি ফরমাশ পেলে তাঁদের ডাকা হয়। সাবিনা জানালেন, একসময় তাঁর কারখানার কর্মচারী শামীম এখন সিরাজগঞ্জে নিজেই কারখানা তৈরি করেছেন। তিনি চান কেউ যেন হতাশায় ভেঙে না পড়েন।