শীর্ষেই থাকছে ধর্ষণের ঘটনা

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

ঢাকায় যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটেই চলছে। গত বছর ধর্ষণ ও গণধর্ষণসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে ঢাকায় মামলা হয়েছে মোট ৫৪৫টি। ধর্ষণের মামলার পাশাপাশি বছরটিতে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৯টি।

ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (সিজিএম) সাধারণ নিবন্ধন খাতা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঢাকার বিচারিক আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগর (৫০টি থানা) ও ঢাকা জেলায় (পাঁচটি থানা) গত বছর নারী ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণজনিত হত্যা, আত্মহত্যার প্ররোচনা, যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা, যৌতুক, যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন, মানব পাচার, অপহরণজনিত অপরাধের অভিযোগে মোট ১ হাজার ৭৬৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা (৫৪৫টি) হয়েছে ধর্ষণের। 

বিভিন্ন মামলা পর্যালোচনা করে প্রথম আলোর অনুসন্ধান এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় জড়িত আইনজীবী ও সরকারি কৌঁসুলিরা (পিপি) বলছেন, ধর্ষণ করার পাশাপাশি ধর্ষণের দৃশ্যগুলো মুঠোফোন অথবা গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ফের ভুক্তভোগী নারীকে ধর্ষণ করছে অপরাধীরা। এমন ঘটনায় গত বছর ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৫টি মামলা হয়েছে। 

পিপিরা বলছেন, ধর্ষণ, যৌন পীড়নসহ অন্যান্য নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধের মামলা করার পর বাদীপক্ষদের অনেকেই আসামিদের সঙ্গে একপর্যায়ে আপস করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

প্রথম আলোর দীর্ঘ অনুসন্ধানেও উঠে আসে ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে (বর্তমানে নয়টি ট্রাইব্যুনাল) নিষ্পত্তি হওয়া ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু, যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা, সম্ভ্রমহানি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনা এবং যৌন নিপীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের মামলার সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ। আর মামলার বড় একটা অংশই ছিল ধর্ষণসংক্রান্ত অপরাধের।

ঢাকার বিচারিক আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ঢাকায় ধর্ষণ মামলা হয় ৪২৮টি। ২০১৩ সালে মামলা হয় ৪১৩টি। ২০১৪ সালে ৪৪৩টি, ২০১৫ সালে ৪৯২টি এবং ২০১৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০২টি মামলা। তিন বছরের ব্যবধানে গত বছর ঢাকায় ধর্ষণের মামলা হয় ৫৪৫টি।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের থেকে দ্বিগুণ বেড়েছে। গত বছর সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৭৩২।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণের প্রেমে পড়েন। চার বছর আগে তাঁদের পরিচয় হয়েছিল। গত জুনে ওই তরুণী ধর্ষণের শিকার হন এবং ওই তরুণের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। তরুণীর অভিযোগ, ধর্ষণের পাশাপাশি ওই তরুণ ধর্ষণের দৃশ্য মুঠোফোনেও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন। গত ৫ ডিসেম্বর তরুণকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়।

রাজধানীর ১৫ বছরের কিশোরী ২৪ বছর বয়সী এক যুবকের প্রেমে পড়ে। গত ২২ নভেম্বর যুবক ওই কিশোরীকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। কিশোরীকে কোমল পানীয়ের সঙ্গে চেতনানাশক ট্যাবলেট খাওয়ান। পরে প্রেমিকসহ চারজনে মিলে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় কিশোরীর বাবা শেরেবাংলা নগর থানায় বাদী হয়ে পাঁচজনের নামে গণধর্ষণের মামলা করেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক মুহম্মদ আহাদী আলী ঢাকার আদালতকে এক প্রতিবেদন দিয়ে বলেন, ভুক্তভোগী কিশোরীকে যে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল, তা মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে।

যৌন হয়রানি, বিশেষ করে ধর্ষণের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে পরিচিতজনদের মাধ্যমে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে কয়েক বছর ধরে পিপির দায়িত্ব পালন করছেন আবদুল বারী ও মাহমুদা আক্তার। তাঁরাও বলেন, বেশির ভাগ নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন পরিচিত লোকজনদের মাধ্যমে। থানায় মামলা না নিলে ভুক্তভোগীরা আদালতে এসে মামলা করছেন, মামলা করার পর আসামিদের গ্রেপ্তারও করছে পুলিশ। তবে বিচার চলাকালে অনেক নারী আদালতে হাজির হয়ে আসামির (পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন) জামিনে আপত্তি নেই বলে আদালতকে জানান। তখন আসামিরা জামিনে মুক্ত হন। মামলা নিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার। 

গত বছর দায়ের করা ধর্ষণসংক্রান্ত অন্তত ৪০টি মামলার কাগজপত্র ঘেঁটেছে প্রথম আলো। এতে দেখা গেছে, গত বছর ঢাকায় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বিশেষ করে সৎবাবারা একাধিক কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করেছেন এবং এসব ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় দুই কিশোরীকে তাদের সৎবাবারা ধর্ষণ করেন। কিশোরীদের মায়েরা বাদী হয়ে থানায় মামলা করলে দুই সৎবাবাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। 

আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলেন, ঢাকাকে নারী ও শিশুবান্ধব বলার কোনো উপায় নেই। নারী ও শিশুরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করার পর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, মামলা আপস করা, অপরাধীদের শাস্তি না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে নারী নির্যাতন কমছে না। ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। আসামিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হলে ধর্ষণের ঘটনা কমানো সহজ হতো।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, আগের চেয়ে সচেতনতা বেড়েছে বলে মানুষ আইনের আশ্রয় বেশি নিচ্ছে। এখন অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি কার্যকর করা জরুরি। আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি ধর্ষণ-গণধর্ষণসহ এ ধরনের অপরাধগুলো কমানোর জন্য নৈতিক শিক্ষা খুব জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।