ঝাঁপ দিই আকাশে

>
রোমাঞ্চের টানেই আকাশে ঝাঁপ েদওয়া শুরু করেন রাজেন্দ্র সরকার। একটি স্কাইডাইভিংয়ে আকাশে মেলে ধরেছেন লাল–সবুজ পতাকা। ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত
রোমাঞ্চের টানেই আকাশে ঝাঁপ েদওয়া শুরু করেন রাজেন্দ্র সরকার। একটি স্কাইডাইভিংয়ে আকাশে মেলে ধরেছেন লাল–সবুজ পতাকা। ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত
বাংলাদেশি তরুণ রাজেন্দ্র সরকার থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এরিকসনের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী। শখের বশে শুরু করেছিলেন স্কাইডাইভিং। আকাশে ঝাঁপিয়ে পড়া এখন তাঁর কাছে স্রেফ শখ নয়, একটি খেলা। লাইসেন্সধারী স্কাইডাইভার হিসেবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কারও। তাঁকে নিয়েই এবারের রচনা।

এক-দুবার তো নয়, গুনে গুনে ১৭০ বার আকাশ থেকে পড়েছেন রাজেন্দ্র সরকার। বাংলা বাগ্‌ধারার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল করবেন। এই ‘আকাশ থেকে পড়া’ মানে আক্ষরিক অর্থে যা বোঝায়, তা-ই। ইংরেজিতে যাকে বলে স্কাইডাইভিং। বাংলায় আপনি চাইলে পাগলামিও বলতে পারেন!

স্কাইডাইভিং মূলত একটা খেলা। সহজ করে বললে এ খেলার নিয়ম হলো, উড়ন্ত বিমান বা হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পেরোনোর পর প্যারাসুটের সাহায্যে মাটিতে নেমে আসা। খেলাটির আরও নানা ধরন বা নিয়মকানুন আছে। তবে মোদ্দা কথা এটাই, আকাশ থেকে পড়া।

আমাদের দেশের অনেকেই শখ করে স্কাইডাইভিং করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সংযুক্ত আরবআমিরাত, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে এই রোমাঞ্চের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে রাজ সরকারের কাছে স্কাইডাইভিং স্রেফ শখ নয়। তিনি একজন লাইসেন্সধারী স্কাইডাইভার। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। বিখ্যাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এরিকসনের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি নিয়মিত স্কাইডাইভিং করেন তিনি। এই খেলার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন।

মাসখানেক আগে ই–মেইলে যোগাযোগ করেছিলেন রাজেন্দ্র সরকার। দু-তিনটি ই-মেইল আদান-প্রদানের পর হুট করেই একদিন ফোন করে বললেন, ‘ভাই, আমি ছুটিতে দেশে এসেছি। একবার দেখা করা যায়?’

বললাম, ‘চলে আসেন।’

গত ৩০ ডিসেম্বর রাজেন্দ্র সরকার এলেন ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে। সঙ্গে নানা অভিজ্ঞতার ঝুলি, আর স্ত্রী মিথিলা গুহ। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন মিথিলা। কফিতে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো দুজনের সঙ্গে।

মেঘ এনেছি ডেকে

সাধারণের মাথায় যে প্রশ্নটা সবার আগে আসে, সেটাই ছুড়ে দিই।

 ‘ভয় লাগে না?’

রাজেন্দ্র সরকার হয়তো আকাশে ভাসতে ভাসতে নিজেকে পাখিই ভাবেন! ছবি: সংগৃহীত
রাজেন্দ্র সরকার হয়তো আকাশে ভাসতে ভাসতে নিজেকে পাখিই ভাবেন! ছবি: সংগৃহীত

রাজেন্দ্র বলেন, ‘প্লেনের বাইরে পা রাখাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। এরপর সহজ।’ বটে। একবার লাফ দিয়ে ফেললে তো আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই! অনেকে বিমানের দরজা পর্যন্ত গিয়েও লাফ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার ঘটনাও আছে। রাজেন্দ্র বললেন, ‘খেলাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা ঠিক। কিন্তু আপনি যদি পরিসংখ্যান দেখেন, দেখবেন স্কাইডাইভের চেয়ে রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি। মানুষ ভয় পায়, কারণ, এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্য কোনো অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না।’

ছেলেবেলায় রাজেন্দ্র সরকার পাইলট হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা-বাবার ইচ্ছা ছিল, ছেলে প্রকৌশলী হোক। অগত্যা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রনিকস ও যোগাযোগ প্রকৌশলে স্নাতক হন তিনি। স্নাতকোত্তরের জন্য ২০১২ সালে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। দুই বছর পর যোগ দেন এরিকসনে। পড়ালেখা, চাকরির ফাঁকে ফাঁকেই স্কাইডাইভিংয়ের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে একদিন সময় করে হাজির হয়ে যান ডালাস স্কাইডাইভিং সেন্টারে।

পাখির মতো ওড়া

প্রথমবার স্কাইডাইভিং করতে গিয়েই এক বিচিত্র জগতের সঙ্গে পরিচয় হয় রাজেন্দ্র সরকারের। কত দেশের কত রকম মানুষ! বয়স ১৮ পেরোনোর আগে এই খেলায় অংশ নেওয়ার নিয়ম নেই। অনেকে তাই ১৮তম জন্মদিনেই হাজির হয়ে যান। রাজেন্দ্র বলছিলেন, ‘আমাকে যিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তিনি একজন চিকিৎসক। আবার আর্নি ল্যাং নামের একজন ৬৫ বছর বয়সী পেশাদার স্কাইডাইভারের সঙ্গেও আমার পরিচয় আছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার ডাইভ দিয়েছেন তিনি।’

স্কাইডাইভিংয়ের লাইসেন্সের বেশ কয়েকটি ধাপ আছে—এএএফ (এক্সিলারেটেড ফ্রি ফল), এ, বি, সি এবং ডি। রাজেন্দ্র সরকার এখন বি পর্যায়ে আছেন (সাধারণত ৬০টি লাফ দেওয়ার পর বি লাইসেন্স পাওয়া যায়)। প্রায় ২০০ বার লাফ দেওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হওয়ার পর পাওয়া যায় সি লাইসেন্স। এ বছর মার্চের মধ্যেই এই লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলার পরিকল্পনা রাজেন্দ্র সরকারের। তবে আরও একটা বড় স্বপ্ন আছে তাঁর। সেটাও বললেন।

 ‘স্কাইডাইভিংয়ের আরেকটা ধরন হলো উইংস্যুটিং। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমি একজন উইংস্যুটার হতে চাই। উইংস্যুটিং মানে শুধু আকাশ থেকে ঝাঁপ দেওয়া নয়, বিশেষ একটা পোশাক পরে উড়ে যাওয়া। আপনারা হয়তো সিনেমায় দেখে থাকবেন। আবার একধরনের উইংস্যুটার আছেন, যাঁরা মাটির খুব কাছ দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় দেড় শ মাইল বেগে উড়ে যান। সেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’

মনে মনে তখন ভাবতে শুরু করেছি, ‘এরা নির্ঘাত পাগল!’ ধারণা বদলে গেল রাজেন্দ্রর পরের কথায়।

ভয়কে জয়

স্কাইডাইভাররা কি একটু খ্যাপাটে ধরনের হন?

প্রশ্নটা একেবারেই নাকচ করে দিলেন রাজেন্দ্র। বললেন, ‘ভুল। বরং তাঁরা খুব ঠান্ডা মাথার শান্ত মানুষ। কারণ, এখানে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রতি সেকেন্ডে। তাড়াহুড়োয় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই মাথা ঠান্ডা রাখা ছাড়া উপায় নেই।’

একদিন নিজেও বড় দুর্ঘটনায় পড়তে যাচ্ছিলেন। রাজেন্দ্র শোনালেন সেই গল্প।

 ‘আপনার সঙ্গে মাটির দূরত্ব যখন ৩৫০০ ফুট, সাধারণত তখনই প্যারাস্যুট খুলতে হয়। একবার প্যারাস্যুট খুলতে গিয়ে দেখি, বেশ কয়েকটা দড়ি পেঁচিয়ে গেছে। এ ধরনের সমস্যায় পড়লে সাধারণত প্যাঁচগুলো খোলার চেষ্টা করতে হয়। তবে বেশিক্ষণ নয়, বড়জোর চার-পাঁচ সেকেন্ড সময় পাবেন আপনি। কখনো কখনো আরও কম। খুলতে না পারলে আপনাকে ঝটপট দড়িগুলো কেটে ফেলে রিজার্ভ প্যারাসুট ব্যবহার করতে হবে।’

কাটার পিন থাকে ডান দিকে আর রিজার্ভ প্যারাস্যুট খোলার ব্যবস্থা থাকে বাঁ দিকে। অনেকেই এ সময় ঘাবড়ে গিয়ে কাটার পিন বের করতে গিয়ে রিজার্ভ প্যারাস্যুট খুলে ফেলেন। একসঙ্গে দুটো প্যারাস্যুট খোলার মতো ভুল করে ফেললে আর রক্ষা নেই, নিশ্চিত মৃত্যু!

রাজেন্দ্র ভুল করেননি। প্যারাস্যুটটা যখন তিনি সামলে এনেছেন, তখন মাটি থেকে তাঁর দূরত্ব মাত্র ১৩০০ ফুট। কিছুটা ব্যথা পেয়েছেন, তবে বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন।

রাজেন্দ্র সরকার এসব ঘটনা বলার সময় আড়চোখে তাঁর স্ত্রী মিথিলা গুহর মুখভঙ্গি দেখছিলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিথিলা হেসে বললেন, ‘ও যখন স্কাইডাইভিংয়ে যায়, দুই ঘণ্টা পরপর আমাকে মেসেজ পাঠায়, “আই অ্যাম স্টিল অ্যালাইভ।”’

লাল-সবুজের অপেক্ষা

যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন স্কাইডাইভিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন রাজেন্দ্র। একটাতে দলগতভাবে হয়েছেন প্রথম, আরেকটাতে দ্বিতীয়। সামনে আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথাও ভাবছেন। তবে এ ক্ষেত্রে একটা আফসোসের কথা বললেন তিনি, ‘ফরমেশন স্কাইডাইভিংয়ে ছোট ছোট দল মিলে অংশ নেয়। নানা দেশের মানুষ নিজেরা দল করে আসেন। তাঁদের পোশাক হয় তাঁদের পতাকার রঙে। এ ক্ষেত্রে আমার সমস্যা হলো, আমাকে অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে একটা বহুজাতিক দলে অংশ নিতে হয়। কারণ, বাংলাদেশি আর কেউ নেই।’

আকাশ থেকে যখন মাটিতে নামলেন।
আকাশ থেকে যখন মাটিতে নামলেন।

রাজেন্দ্র স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলাদেশেরও একটা দল হবে। খেলাটা একটু ব্যয়বহুল। তবে রাজেন্দ্র বললেন, ‘রেসিং বা সার্ফিংয়ের মতো স্কাইডাইভিংও একটা রোমাঞ্চকর খেলা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রচারণার সুযোগ আছে।’

নীরবতায় স্নান
স্কাইডাইভিংয়ের অনুভূতিটা কেমন? ঘুরেফিরে জানতে চাইছিলাম রাজেন্দ্র সরকারের কাছে। কিন্তু তাঁর বর্ণনা ঠিক জুতসই হচ্ছিল না। একে তো ১৭০ বার স্কাইডাইভিং করে বিষয়টা তাঁর কাছে ‘ডালভাত’ হয়ে গেছে, তার ওপর তিনি একজন প্রকৌশলী। ‘টার্মিনাল ভ্যালুসিটি’, ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’, এমন আরও নানা শব্দ উচ্চারণ করে সাধারণের জন্য তিনি বর্ণনাটা খটমট করে ফেলছিলেন।

উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় এগিয়ে এলেন মিথিলা গুহ। ট্যানডেম স্কাইডাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। শখ করে যাঁরা স্কাইডাইভিং করেন, এই পদ্ধতি তাঁদের জন্য। এ ক্ষেত্রে একজন পেশাদার স্কাইডাইভারের সঙ্গে শরীর বাঁধা থাকে। প্যারাস্যুট নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তিনিই নেন।

মিথিলা বলছিলেন, ‘প্রথম চার-পাঁচ সেকেন্ড প্রচণ্ড ভয় লাগে। কিন্তু ওপর থেকে দেখতে এত সুন্দর, পরের মুহূর্তগুলোতে আপনি একরকম হতভম্ব হয়ে যাবেন। প্রচণ্ড বাতাস মুখে লাগতে থাকবে। নিজেকে পাখি মনে হবে। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো নিস্তব্ধতা। যত জোরেই চিৎকার করেন, কেউ শুনবে না; এমনকি পেছনে থাকা আপনার ইনস্ট্রাক্টরও না।’

রাজেন্দ্র যোগ করলেন, ‘এই অনুভূতি আসলে বলে বোঝানো যাবে না। এর টানেই তো মানুষ বারবার স্কাইডাইভিং করতে যায়।’

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ভাষা যখন হার মানে, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণ নেওয়াই তো নিয়ম।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আলোর সঙ্গে আকাশ যেথায় এক হয়ে যায় মিলে শুভ্রে এবং নীলে/তীর্থ আমার জেনেছি সেইখানে/অতল নীরবতার মাঝে অবগাহনস্নানে।’ ব্যাপারটা বোধ হয় অনেকটাই এমন।