নির্যাতনের কথা বলতে হবে: শার্লিজ থেরন

শার্লিজ থেরন
শার্লিজ থেরন

যৌন হয়রানির বিভীষিকা

১৯৯৪ সালের কথা। আমাকে আমার প্রথম অডিশনের জন্য মডেলিং এজেন্সি থেকে একজন খ্যাতিমান পরিচালকের বাড়িতে পাঠানো হয়। শনিবার রাত ছিল। ছুটির দিন। ভেবেছিলাম, এত বড় নির্মাতা, নিশ্চয়ই ব্যস্ততার কারণে ছুটির দিনে বাড়িতে কাজ করছেন। তাই সেখানেই অডিশন নেবেন। কিন্তু দরজা খুলতেই তাঁকে দেখলাম পাজামা পরা, খুব সাদামাটাভাবে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কথা বলতে বলতে তিনি আমার হাঁটুর কাছ থেকে তাঁর হাত আরও ওপরের দিকে নিতে থাকলেন। এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হয় সেটা তখনই বোঝা খুব কঠিন। আমি সেই সময় তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে আসি। এরপর গাড়িতে বসে নিজেকেই দোষ দিতে থাকি। কেন আমি কিছু না বলে, উল্টো ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেলাম? কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই ধরনের মুহূর্ত একজনকে এতটাই বিপর্যস্ত করে দেয় যে আমরা যা বলা উচিত বলে ভাবি, সেটা আসলে মুখ পর্যন্ত আসে না। আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল। আমার ভেতর সেই ক্ষোভ অনেক বছর পর্যন্ত ছিল।

এর ঠিক ৮ বছর পর সেই পরিচালকের সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়। তখন তিনি নিজে এসেছিলেন আমার কাছে ছবির প্রস্তাব নিয়ে। আমি তাঁর সঙ্গে ছবির প্রযোজকসহ মিটিংয়ে বসেছিলাম। চেয়েছিলাম সেদিন তাঁর মুখের ওপর যে কথাগুলো বলতে পারিনি, ৮ বছর পর সেগুলো বলব। প্রযোজক যখন আমাকে ওই পরিচালকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, আমি তখন বললাম— ‘আমাদের আগেও দেখা হয়েছে। মনে নেই? একবার আপনার বাসায় আমাকে অডিশনের জন্য ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমার হাঁটুর ওপর হাত রেখেছিলেন। আমি বেরিয়ে এসেছিলাম…’ ওই নির্মাতা তখন এমনভাবে সব অস্বীকার করে গেলেন আর বিষয়টা এড়াতে চাইলেন যে আমি বুঝে গেলাম, এই কাজ ওই লোক নিয়মিতই করতেন। তাই ৮ বছর আগে আমার সঙ্গে করা অন্যায় তাঁর মনে নেই। আমি বুঝে গেলাম, আমি তাঁকে যেভাবে আঘাত করতে চাই, তিনি সেভাবে আহত হবেন না। কারণ, তাঁর ভেতর অপরাধবোধের কোনো ছায়াও ছিল না। 

কিন্তু আমি স্পষ্ট করতে চাই, যৌন নির্যাতন সব সময় শারীরিকভাবে হয় না। শুধু ধর্ষণই যৌন নির্যাতন নয়। কিছু মানসিক নির্যাতন যা মুখের কথায়, অঙ্গভঙ্গি, স্পর্শ আর চাকরি কিংবা সম্পর্ক ভেঙে ফেলার ছোট ছোট হুমকির মধ্য দিয়ে হয়, সেটাও নির্যাতন। এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি একাধিকবার হয়েছি।

আমি সেই যৌন হেনস্তাকারী পরিচালকের নাম প্রকাশ করেছিলাম। এটা লোকে না জানার পেছনে একটা কারণ আছে। সেটা হলো, যতবার আমি তাঁর নাম গণমাধ্যমে নিয়েছি, ততবার সাংবাদিকেরা তাঁর নাম প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই আমি বুঝে গেছি, এই সমস্যাটা কতটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমাদের সমাজে থিতু হয়ে গেছে। 

আমার মনে আছে, যেবার প্রথম একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কোনোদিন কাস্টিং কাউচের (সিনেমায় অভিনয়ের জন্য অডিশনের সময় হওয়া হয়রানি) শিকার হয়েছি কি না। আমি প্রথমবারের খোলাখুলি আমার সেই হয়রানি নিয়ে কথা বলেছিলাম, জানিয়েছিলাম সেই ব্যক্তির নামও—যিনি আমাকে হয়রানি করেছেন। কিন্তু প্রশ্নকর্তা নিজের সিদ্ধান্তে সেই নামটি প্রকাশ করেননি। যখন হার্ভি ওয়াইনস্টিনের (হলিউড প্রযোজক) বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠল, আমার হয়রানির খবরগুলো একের পর এক সামনে আসতে শুরু করল, তখন আমি আমার সেই কাস্টিং কাউচের খবরটা খোঁজ করলাম গুগলে। দেখলাম, ওই খবরটা সবখানেই প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু কোনো লেখার কোথাও ওই ব্যক্তির নাম ছিল না। আমার জন্য ওই আবিষ্কারটা ছিল হৃদয়বিদারক। 

এখন আমার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সব সময় কাজ করে। আমি যদি এখন কোনো ছবির প্রচারণায় গিয়ে গণমাধ্যমকে আবার সেই নামটা বলি, তাহলে পুরো বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যাবে। দেখা যাবে আমার সিনেমা নয়, আলোচনায় উঠে এসেছে ওই লোকটার নাম। আমি আমার পরিশ্রম দিয়ে বানানো ছবির সঙ্গে তাই আর ওই লোকের নাম জুড়তে চাই না, তাই এখন আর আমি তাঁর নাম নিতে চাই না। আমার মনে হয়, একদিন আমারও সময় আসবে, যখন সঠিক জায়গায়, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে আমি সব বলব। 

মায়ের হাতে বাবার মৃত্যু

আমার মা প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও পরিশ্রমী একজন মানুষ। ছোটবেলায় আমি তাঁকে দেখেছি নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতে, যে সময় মেয়েরা এসব ভাবতেও পারত না। কিন্তু আমার মা ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে সব সময় কাজ করে গেছেন, আমাদের সেভাবেই বড় করেছেন। আমার বাবা ছিলেন অসুস্থ একজন মানুষ। সারা জীবন তাঁর অ্যালকোহলের নেশায় কেটেছে। আমি সব সময়ই তাঁকে মাদকে আসক্ত অবস্থাতেই দেখেছি। 

এটা যে কতটা অসহায় অবস্থা ছিল, বোঝানো যাবে না। এই আসক্তির কারণে আমাদের পুরো পরিবার দুর্যোগের মধ্যে পড়ে থাকত। একজন মাদকাসক্তের সঙ্গে জীবন কাটানো মানে শরীরে একটা মরণব্যাধি বয়ে বেড়ানোর মতো। মনে হচ্ছিল এই অসহায়ত্ব থেকে আমরা কোনো দিন বের হতে পারব না। 

কিন্তু একটা রাত সবকিছু বদলে দিল। ১৯৯১ সালের ২১ জুনের কথা। যদিও আমি কোনোদিনও চাইনি এমন কিছু ঘটুক। সেই রাতের বিভীষিকা আমার মনে একটা ভীতিকর ছাপ রেখে গেছে, যা কোনোদিন মুছে ফেলা যাবে না। কোনো সমস্যার মোকাবিলা করতে গিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাওয়াটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এমনই একটি ঘটনা ঘটে যায় আমার পরিবারের সঙ্গে। 

ওই রাতে আমার বাবা এতটাই মদ্যপ ছিলেন যে তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। টলতে টলতে তিনি একটা বন্দুক হাতে বাড়িতে ঢুকলেন। আমি আর আমার মা ভয়ে আমাদের ঘরের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাবা একটু পরপর দরজা ঠেলে ঢুকে পড়তে চাইছিলেন। আর আমরা তাঁকে বন্দুক হাতে ঢুকতে দিতে চাইছিলাম না। 

ওই অবস্থাতেই বাবা দরজার দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করতে শুরু করেন। তিনবার গুলি করেন। আমাদের সৌভাগ্য, একটাও আমাদের গায়ে লাগেনি। এটা বিস্ময়কর ছিল। কিন্তু বাবাকে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছিল না। তখন মা আত্মরক্ষার জন্য তাঁর নিজের বন্দুক বের করেন এবং সব কিছু থামিয়ে দেন।

আমার পারিবারিক সহিংসতার এই ঘটনা আমি সবাইকে বলি। এটা বলতে আমার লজ্জা হয় না। কারণ, আমি মনে করি এসব নিয়ে যত আলোচনা হবে, মানুষকে তত বোঝানো যাবে যে দুর্যোগ বা বিপর্যয় আপনার একার নয়। আমার মনে হয় আমার জীবনের এই গল্পটা সবাইকে বুঝতে সাহায্য করবে, মাদকাসক্তি ও মাদকাসক্তের সঙ্গে বসবাস একটি পরিবারকে কোন দিকে নিয়ে যেতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান

সূত্র: ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও, যুক্তরাষ্ট্র