'দেখি, বাসে চালক ছাড়া কেউ নেই'

রাতে খালি বাসে সেলফি তোলেন কিশোয়ার লায়লা। পরে তা ফেসবুকেও পোস্ট করেন।
রাতে খালি বাসে সেলফি তোলেন কিশোয়ার লায়লা। পরে তা ফেসবুকেও পোস্ট করেন।

১২ নভেম্বর। প্রচণ্ড তুষারঝড়ের কবলে কানাডার টরন্টো। সন্ধ্যায় ক্লাস শেষ করে চার ধরনের বাস-ট্রেন বদল করে বাসায় ফিরতে রাত প্রায় নয়টা। বাসায় ফেরার আগে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে শেষ বাসটায় যখন উঠি, দেখি বাসে চালক ছাড়া কেউ নেই। যাত্রী শুধু আমি। চালকের সঙ্গে কথা হলো। একা সেলফি তুললাম। বাসার কাছের স্টপেজে নামার সময় চালককে ‘শুভরাত্রি, তোমার যাত্রা শুভ হোক’ বলে বিদায় নিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছবিসহ শেয়ার দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেশে থাকা এক বন্ধু মেসেঞ্জারে জানতে চাইল— একা রাতে বাসে ফিরলি, তোর ভয় লাগেনি? যদি কিছু হতো? দেশে থাকলে পারতি? হাসির ইমোজি দিয়ে বন্ধুকে বললাম, তাই তো, তুই না বললে এটা আমার মাথাতেই আসত না যে আমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল!

তবে চিন্তাটা মাথায় গেঁথে গেল। এরই মধ্যে দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গীতি আরা নাসরিনের এ–সংক্রান্ত স্ট্যাটাস পড়ে আমি স্তম্ভিত। রাজধানীতেই ওই শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার। যেকোনো মেয়ের ওপর এমন ঘটনাতেই আমি স্তম্ভিত হই। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী? হয়তো আমার বিভাগেরই, হয়তো আমার পরিচিত কারও মেয়ে বা বোন? হয়তো কারও ভালোবাসার মানুষ? সেদিন একা বাসে করে রাতে বাড়ি ফেরার ‘সুন্দর’ অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। আমার একা চলাচলে দেশের বন্ধুটির উদ্বিগ্নতার কথাও মনে পড়ল।

সাত বছর ধরে কানাডায় আছি। দেশে থাকতে সাংবাদিকতা করার সুবাদে রাতে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করেছি। তবে সত্য কথা হলো, এখন দেশে গিয়ে আর সেভাবে রাস্তায় চলাচল করতে পারি না। ঢাকার রাস্তাঘাটে নারীর যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের খবর তো টরন্টোতে বসেও পাই।

টরন্টো একটি উন্নত শহর। এখানে সিকিউরিটি সিস্টেম ভিন্ন। আইনি প্রক্রিয়া কঠোর। কারও যদি মানবিক মূল্যবোধ নাও থাকে, অন্তত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বলুন আর ভয় বলুন, কিছু করার আগে চিন্তা করে। তাই ঢাকার সঙ্গে হয়তো তুলনা করে লাভ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনার পর আমি এখানে কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, রাস্তায় রাতে একা চলাচলে ভয় পাও? সবাই এক বাক্যে বলল, না। কাকে ভয় পাব? আর সবাই তো ব্যস্ত। সর্বত্র সিসি ক্যামেরা।

ভারতের গুজরাট থেকে নয় বছর আগে টরন্টো এসেছেন নাজরানা পাটেল। বললেন, গুজরাটে স্বামীর সঙ্গেও রাতবিরাতে ঘোরাঘুরি করতে পারেননি। এখানে প্রথম এসে ভয় হতো, যদি কিছু হয়। কিছুদিন পর বুঝে গেছেন, এই শহর আর তাঁর শহর এক না।

সাউথ এশিয়ান উইমেন’স রাইটস অর্গানাইজেশন-সরোর নির্বাহী পরিচালক সুলতানা জাহাঙ্গীরের দুই মেয়ে টরন্টোর দুটো ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ক্লাস আর লাইব্রেরি শেষ করে তাঁদের বাসায় ফিরতে প্রায়ই রাত ১১ থেকে ১২টা বেজে যায়। সুলতানা জাহাঙ্গীর বললেন, ‘এখানকার মানুষ মূল্যবোধ নিয়ে চলাচল করে। গণপরিবহনগুলোয় প্রচণ্ড ভিড়েও কারও গায়ের সঙ্গে অনিচ্ছাকৃতভাবেও স্পর্শ লাগে না। অথচ দেশে থাকলে দুই মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে করতেই জীবন পার করতে হতো। দেশে ঘটে যাওয়া খবরগুলো মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা করি। এখন অবস্থা এমন হয়েছে, মেয়েরা বেড়ানোর জন্যও দেশে যেতে চায় না।’
তবে এটাও ঠিক, টরন্টোতে একেবারেই কোনো নেতিবাচক ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। এখানে পার্কে হাঁটতে গিয়ে নারীর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা বা ছিনতাইয়ের ঘটনা বা পূর্বশত্রুতার জের ধরে কোনো মেয়ের ওপর হামলার সংবাদ পাওয়া যায়। তবে সেগুলো সত্যিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমার প্রিয় মাতৃভূমির মতো প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়নি।

কিশোয়ার লায়লা, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কার, টরন্টো, কানাডা