ধর্ষণের শিকার পরিবার: ভোগান্তি পিছু ছাড়ে না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দাবি ধর্ষকের কঠোর শাস্তি ।  ছবি: আবদুস সালাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দাবি ধর্ষকের কঠোর শাস্তি । ছবি: আবদুস সালাম
>গত রোববার রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সপ্তাহে ঢাকাতেই শিশু গণধর্ষণসহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত আসামি ধরেছে। তবে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু এবং পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি যাচ্ছে না। নতুন করে যে কারও ধর্ষণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা তো আছেই।

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু (ভিকটিম) ও তার পরিবারের সদস্যদের পদে পদে নাজেহাল হতে হচ্ছে। ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না। 

ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ঘটনা ঘটার পর থেকেই শুরু হয় ভোগান্তি। থানা, পুলিশ, হাসপাতাল, সমাজের মানুষ— একধরনের ভয়ের মধ্যে অতিক্রম করতে হয়। প্রতি পদেই অপমানিত হতে হয়। বিচারটা দ্রুত পেলে হয়তো ভোগান্তি খানিকটা কমত।

ধর্ষণের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রেপ্তার হয়েছে। এই শিক্ষার্থীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বজন বললেন, এই শিক্ষার্থীর পাশে তাঁর পরিবার আছে। হাসপাতাল, পুলিশসহ প্রায় সব জায়গা থেকেই সহযোগিতা পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁকে প্রতি পদে পদে প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারেও শিক্ষক, নারীনেত্রীসহ অনেকেই মেয়েটিকে দেখতে এসেছেন, বারবার ওই দিনের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তাই বলা যায়, ভোগান্তি তো মাত্র শুরু হয়েছে। 

২০১৫ সালের মে মাসে রাজধানীতে কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক গারো তরুণী (তখন বয়স ছিল ২২)। রাতে কুড়িল বাসস্ট্যান্ড থেকে তাঁকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে একদল দুর্বৃত্ত। পরে থানায় ধর্ষণের শিকার তরুণীর প্রাথমিক অভিযোগ নিতে দেরি করার ঘটনায় পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠনের করা রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ তিনটি রুল ও দুটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

কিন্তু এই তরুণী বা তাঁর পরিবারের ভোগান্তি কি কমেছে? এই তরুণীর আইনজীবী নিপারসন আজিম বললেন, মামলায় ১৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। শুধু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার (আইও) একটিমাত্র সাক্ষী বাকি, তা ঝুলছে তো ঝুলছেই।

এই গারো তরুণীর বাবা মুঠোফোনে জানালেন, তাঁর মেয়ে এমএ পড়ছেন। এই বাবা বললেন, ‘বহু বছর তো হইল, বিচার তো পাইলাম না। বিচারটা পাইলে ভোগান্তিটা একটু কমত। তবে আমি মেয়েকে বলেছি, এইটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। তোমাকে পড়াশোনা করে সামনে অগ্রসর হইতে হইব।’

২০১৬ সালে দিনাজপুরে পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ব্লেড দিয়ে শিশুটির প্রজনন অঙ্গ কাটা ছিল। মাথা, গলা, হাত ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। ঊরুতে সিগারেটের ছেঁকার ক্ষত ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, মেডিকেলের বার্ন ইউনিটসহ বিভিন্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে নিতেই শিশুটি বড় হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে তার প্রস্রাব ঝরে। 

মুঠোফোনে এই শিশুর মা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘বিচার আর কই পাইলাম? সাক্ষী নিয়া যাই, আবার ঘুরি ঘুরি ফেরত আসি। ঘটনার পর শুধু মেয়ে, আমার আর ওর বাবার জবানবন্দি নিছিল। আর কোনো সাক্ষীর জবানবন্দি নেয় না, আদালতে সাক্ষী তুলে না। সাক্ষী আনা–নেওয়ায় খালি খরচই হইতাছে। এখন তো মনে হয় গ্রামে বিচার করলেই ন্যায্য বিচার পাইতাম।’

ধর্ষণের শিকার মেয়েটি বর্তমানে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। তবে তার স্মরণশক্তি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে বলে মা জানালেন। ঘরের বাইরে গিয়ে অপরিচিত পুরুষ মানুষ দেখলেই সে ভয় পায়। সারাক্ষণ প্রস্রাব ঝরে বলে দুই ঊরুর মাঝে কালো দাগ হয়ে গেছে। ডায়াপার কেনার পয়সা তো নেই।

চলতি বছরের ২ জানুয়ারি সাভারে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। ৩ জানুয়ারি ছিল মেয়েটির জন্মদিন, ১১ বছর শেষ করে ১২ বছরে পা দিত সে। মেয়েটির মা মুঠোফোনে বললেন, ‘মামলা করতে ঝামেলা হয় নাই। আসামিও ধরা পড়ছে। তয় মাইয়্যারে এমন ভয় দেখাইছে যে মাইয়্যা খালি কান্দে। আসামি বলছে এই কথা কাউরে কইলে মাইয়্যারে বালুর নিচে পুঁইত্যা ফেলব, বাপ-মায়েরে মাইরা ফালাইব।’

এই মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। বাবা রিকশাচালক। মেয়েটি দাদির সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থাকত। সে সাভারে বেড়াতে এসেছিল। এখন রাজধানীতে দাদির সঙ্গে একটি বেসরকারি সংগঠনের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছে। মেয়েটির ঘটনা গ্রামের বাড়িতে জানানো হয়নি লোকলজ্জার ভয়ে।

রাজধানীতে ইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন ঝালকাঠির সায়মা কালাম। প্রেমিক মাহিবি হাসান নামের এক যুবক বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় গত বছরের এপ্রিল মাসে সায়মা আত্মহত্যা করেন। এই মেয়ের মা রুবিনা বেগম মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করাসহ ঘুরছেন বিভিন্ন জায়গায়।

প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে এই মা ‘গুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ লেখা একটি সিডি ধরিয়ে দিলেন এই প্রতিবেদকের হাতে। এতে মেয়ের সব তথ্য আছে। মেয়ের কাছে যে মুঠোফোন ছিল, তা মা বের করে ওই ছেলের সঙ্গে মেয়ের শারীরিক সম্পর্ক করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভিডিও দেখতে দেখতে বললেন, ‘মেয়েকে বিয়ের কথা বলে ধর্ষণ করছে। পরে বিয়ে করতে চায়নি।’ 

এই মা বললেন, ‘মা হয়ে মেয়ের শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছি, এর থেকে বড় ভোগান্তি আর কী হতে পারে?’ 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা জোর দিয়ে বললেন, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারের ভোগান্তি কমানো সম্ভব। প্রথমত হলো, এ ধরনের ঘটনা যাতে ঘটতেই না পারে। আর যদি ঘটে যায়, তখন ভিকটিম ও পরিবারের সদস্যরা কোথায় যাবেন, তা একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দেয়। অথচ সরকারের ম্যাকানিজম, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সবই আছে। সমস্যা হলো এগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী ও শিশুর সুরক্ষায় কমিটি আছে। এই কমিটিগুলো সক্রিয় হলে একটি ঘটনা ঘটার পর কমিটিই বলে দিতে পারে, ভিকটিম কোথায় যাবে। একইভাবে জাতীয় পর্যায়ের কমিটিকেও সক্রিয় হতে হবে। ভিকটিম যেখানে যাচ্ছে, সেখানে সেবাটা পাচ্ছে কি না, তা নজরদারি করতে হবে। যদি সেবা না পায়, তাহলে দায়ী ব্যক্তিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর জনগণকে সম্পৃক্ত করে জবাবদিহির কাজগুলো নিয়মিত করা কঠিন কোনো বিষয় নয়। তবে এই সমন্বয় করে কাজগুলো করার জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকাও জরুরি।