ভোগান্তি বেশি, উদ্যোগ কম

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় নগরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে এক শিক্ষাথী।  ছবি: আবদুস সালাম
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় নগরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে এক শিক্ষাথী। ছবি: আবদুস সালাম

বসুন্ধরা থেকে মিরপুরে উবার মোটোতে যেতে যেতে খেয়াল করলেন, প্রচণ্ড গতিতে মোটরবাইকটি ছুটছে উল্টো দিকে। একটা সময় সেটা থেমে গেল অচেনা জায়গায়। গলায় ক্ষুর ধরলেন চালক। নারী যাত্রী রক্ষা পেয়েছেন কৌশলে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে।

ঘটনাটি গত বৃহস্পতিবারের। ভুক্তভোগী এই নারী বনানী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন। এই নারী বললেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে সময় পার করতে লাগলাম। বললাম, টাকা লাগলে নেন, কোনো ক্ষতি করবেন না। আমি বনানীতে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে একটা বুথ থেকে টাকা তুলে দিয়েছি।’

এই ঢাকা শহর আদতে নারীর জন্য কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কিছু বছর ধরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণসহ ঢাকা ও ঢাকার আশপাশেই ঘটে গেছে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা। ফলে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে, এই ব্যবস্থাগুলো আসলে ঠিক কতটা কার্যকরী?

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ বছর চারেক আগে ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে নারীর জন্য নিরাপদ নগরীর একটি ধারণা দিয়েছে। গবেষণা বলছে, নিরাপদ নগরী সেটিই, যেখানে নারী সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হন না। নারী নিজেকে একঘরে মনে করেন না। ভয় বা হয়রানি ছাড়া তিনি জীবন যাপন করেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয় ও পানি পান। মনের আনন্দে চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। এখানে নারী বলতে ওই নারীর জন্ম হতে পারে শহরে অথবা তিনি অভিবাসীও হতে পারেন, হতে পারেন ছাত্রী বা পর্যটক।

তবে নগরটিতে বসবাসকারী নারীরা বলছেন,া নগর হিসেবে ঢাকাকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না । তাঁরা চান ঝকঝকে আলোর শহর, সংবেদনশীল পুলিশের যথেষ্ট উপস্থিতি ও বিপদের সময় অথবা একান্তই বিপদ ঘটে গেলে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা। অন্যদিকে অনেকেই যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে বা সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কেও ওয়াকিবহালও নন। 

পথঘাটের ভোগান্তি

বয়স কুড়ির শেষভাগে এমন একজন নারী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বললেন, পথে–ঘাটে তো প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্তকরণ ও বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তিনি বললেন, একদিন মোটামুটি ফাঁকা রাস্তায় অস্বাভাবিক ধীরগতিতে অটোরিকশা চালাচ্ছিলেন এক চালক। একটু পর দেখেন, সিএনজি অটোরিকশাচালক কাচটি তাঁর দিকে স্থির রেখে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করছেন। তিনি নেমে যেতে চাইলে অটোরিকশাচালক বাধা দেন। অনেকটা জোরাজুরি করে নেমে আসেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আরেক ছাত্রী বললেন, গাড়িচালকের সহকারী বাসে ওঠানোর সময় শরীরের পেছনের দিকে স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়ে
বাসে ওঠান। 

উচ্চমাধ্যমিক ও¯স্নাতকপড়ুয়া তিনটি কন্যাসন্তানের মা শাহনাজ আক্তার বললেন, নিরিবিলি ও পর্যাপ্ত আলো নেই—এমন পথ যেন এড়িয়ে চলে এবং যে বাসে নারী যাত্রী নেই বা কম যাত্রী আছে, সেই বাসে যেন না ওঠে। বাকিটা তিনি ‘আল্লাহ’র ভরসায় ছেড়ে দিয়েছেন।

দায়িত্ব কার, করছে কী

নগরীকে নারীবান্ধব করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

লালবাগে বার্গারে কেল্লাফতের কর্ণধার ফাহমিদা মিশু প্রথম আলোকে বললেন, লালবাগ থেকে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় ফেরার পথে রাতের দিকে সড়কের বেশির ভাগ জায়গাতেই যথেষ্ট আলো থাকে না। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলেই রাস্তাঘাট অন্ধকার ও সুনসান। তখন শুধু নারী কেন, এই পথে চলাচলকারী পুরুষেরাও আতঙ্কে থাকেন। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহতাব আহমেদের দাবি, সব সড়কে বাতি আছে। আলোর কোনো সমস্যা নেই। 

অর্থাৎ যাঁরা প্রতিদিন ঘর থেকে বের হন, তাঁদের কথার সঙ্গে মেলেনি নির্বাহী প্রকৌশলী মাহতাব আহমেদের কথা। 

গণপরিবহনে নারীদের ভোগান্তির অন্ত নেই। ছবি: দীপু মালাকার
গণপরিবহনে নারীদের ভোগান্তির অন্ত নেই। ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবাশ্বের চৌধুরীও বললেন, আলোর কোনো অভাব নেই। তবে পরে বললেন, কারও পক্ষেই শতভাগ রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তিনি জানালেন, উত্তরে এলইডি লাইট বসানোর একটা কর্মসূচি আছে। সেটি শেষ হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সড়কে নয়, মালিবাগ-মগবাজার ও কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর ও নিচ—দুই জায়গাতেই আলোর স্বল্পতা আছে।

ঢাকায় নারীদের জন্য অনিরাপদ জায়গা কোনগুলো, সে সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোনো তথ্য আছে কি না, নিরাপত্তার জন্য উদ্যোগ কী—জানতে চাওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে। অপরাধের সংখ্যাভেদে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি না, প্রশ্ন করা হয় তা–ও।

ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান বললেন, নগরীতে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা আছে। অপরাধটা ঘটছে পুলিশের অনুপস্থিতিতে, টহল দেওয়ার আগে বা পরে। ফলে সব সময় অপরাধ মোকাবিলা করা যায় না। তবে তাৎক্ষণিক সাহায্যের জন্য যে কেউ ৯৯৯–এ ফোন করে সেবা নিতে পারেন।

কিন্তু নারীরা বলছেন, শুধু পুলিশ হলেই চলবে না, আস্থা রাখতে পারেন এমন পুলিশ চাই। গেল বছরের অক্টোবরে তল্লাশিচৌকিতে অটোরিকশা থামিয়ে এক নারীকে হয়রানির ভিডিও ভাইরাল হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে কর্তৃপক্ষ পরে ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। তা ছাড়া ওই একই বছর পুলিশ কর্মকর্তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুলিশ স্টাফ কলেজের ‘কনভিকশন অব রেপ কেসেস: আ স্টাডি অন মেট্রোপলিটন সিটিজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাতেই দেখা গেছে, ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক নারী-শিশু হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন ৯৪ শতাংশ নারী। ঢাকার ভেতর চলাচলকারী এসব বাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের।

বিআরটিএতে ঢাকা মহানগর পরিবহন কমিটি আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাড়া নিয়ে সমস্যার কথা এই কমিটিকে জানানোর দৃষ্টান্ত আছে, কিন্তু নারীরা হয়রানির শিকার হলে এই কমিটিকে অভিযোগ জানিয়েছেন, এমন কোনো খবর বিআরটিএ জানাতে পারেনি।

১০৯ কী করছে?

নারী ও শিশুদের বিপদে তাৎক্ষণিকভাবে পাশে দাঁড়াতে ২০১২ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০৯ হট নম্বর চালু করে। এ ছাড়া জয় অ্যাপ নামে একটি অ্যাপ রয়েছে। যাঁদের মুঠোফোনে জয় অ্যাপ রয়েছে, তাঁরা বিপদে পড়লে একটি বাটন চাপলেই মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, নিকটবর্তী থানায় তথ্য পৌঁছে যাবে। এমনকি তিনি যে জায়গায় রয়েছেন বা তাঁকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানকার ছবিও পৌঁছে যাওয়ার কথা।

বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ১২ জন নারীর একটি ফেসবুক গ্রুপে ১০৯ ও জয় অ্যাপ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মাত্র একজন বলতে পেরেছেন এই নম্বর ও অ্যাপটি কী ও কেন। তাঁরা সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো নিয়ে প্রচারের অভাবকেই দায়ী করলেন। 

জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৯ জুন থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নম্বরে ফোন এসেছে ৩১ লাখ ৭ হাজার ৪৮৬টি। এর মধ্যে ৮৭ ভাগ (২৭ লাখ ৩৪ হাজার ৮৮টি) ফোন এসেছে ১০৯ কী, সে সম্পর্কে সাধারণ তথ্য জানতে।

এই হট নম্বরটি পরিচালনা করেন কর্মসূচি ব্যবস্থাপক রইসুল ইসলাম। তিনি বললেন, এক কিশোরী পাচার হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে একবার একটি ফোন এসেছিল। এর বাইরে বিপদে পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ এই নম্বরে ফোন করেননি।

একশনএইড বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক ফারাহ কবীর বললেন, নগরীতে নারীর যে নিরাপত্তাব্যবস্থা, তা যথেষ্ট নয়। যেটুকু আছে, তাও দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফল। তিনি নিরাপত্তার জন্য অপরাধপ্রবণ এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানো, পুরুষদের সচেতন করা এবং ঘটনা ঘটে গেলে বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারপ্রধানসহ কর্তৃপক্ষের ঘোষণা ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার বলে মন্তব্য করেন।