সবার গল্প বলা হয় না : জ্যাক মা

জ্যাক মা
জ্যাক মা

চীনের সবচেয়ে ধনী মানুষের নাম জ্যাক মা। তিনি বিখ্যাত চীনা ই-কমার্স সাইট আলীবাবার সহপ্রতিষ্ঠাতা। গত বছর আলীবাবা থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর কথা, ভাবনা, জীবনদর্শন সব সময় তরুণদের অনুপ্রেরণা দেয়। ২০১৭ সালে রাশিয়ার লমোনোসভ মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সামনে কথা বলেছিলেন তিনি।

যখন তরুণ ছিলাম, বয়স কম ছিল, তখন আমি জীবনের অনেক ভুল করেছি, অনেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার মনে হয় জীবনে সফল হতে গেলে প্রতিটি ভুলই হয়ে ওঠে একেকটা ইতিহাস। ব্যর্থ হলে ওগুলো আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই না। সবার জীবনেই দারুণ সব গল্প আছে, সবাই কত রকম ভুল করে, প্রতিনিয়ত অনেক অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু খুব মানুষই তাঁদের সেই ভুল, ব্যর্থতা আর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো বলতে পারে। কেউ যখন সফল হয়ে যায়, তখন তাঁর গল্পগুলো মানুষ শুনতে চায় আর অবাক হয়। বলতে থাকে ‘তুমি তো দারুণ!’ সত্যি বলতে, আমি মোটেও দারুণ নই। আমার জন্ম একটি সাধারণ পরিবারে। আমার পড়াশোনাও খুব বড় জায়গায় হয়নি। আমি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওই বয়সে আমি সেরা স্কুলে পড়ার সুযোগ পাইনি। তাই ভালো চাকরি, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তবে আমি হাল ছাড়িনি।

এসবের মধ্যে আমি কিছু শিক্ষা পেয়েছি। তার মধ্যে একটি হলো—সবারই ব্যর্থ হওয়ার অভ্যাস থাকতে হবে। তবে ব্যর্থ হয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে চলবে না। কেন আরেকজন তোমাকে সাহায্য করবে? অন্যের সাহায্য প্রার্থনা কোরো না। লোকে যেন গায়ে পড়ে তোমাকে সাহায্য করতে আসে, সেই যোগ্যতা অর্জনের জন্য পরিশ্রম করো। জীবন থেকে পাওয়া আমার আরও কিছু শিক্ষা হলো— হাল ছেড়ো না। জেনো, তোমার সুযোগ এখনো আসেনি। যখন সবাই কোনো বিষয় নিয়ে অভিযোগ শুরু করবে, ভাববে সেখানেই তোমার জন্য কোনো সুযোগ লুকিয়ে আছে।

বিচক্ষণ মানুষের সঙ্গ

যখন আমি ছোট, বিদ্যালয়ে বা উচ্চিবদ্যালয়ে পড়ি, তখন ভাবতাম বিল গেটসরা আমার বড় হওয়ার সুযোগটা নিয়ে নিয়েছেন। যা যা করার, যতটা সফল হওয়ার, তাঁরা সবই করে ফেলেছেন। আমার আর করার কিছু নেই। তবে একটা সময় বুঝতে পারলাম, আমার ভাবনাগুলো অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী। আমাকে আগে আশপাশের মানুষদের মধ্যে থেকে তাঁদের জন্য কাজ করতে হবে। ছোট ছোট কাজ দিয়ে শুরু করতে হবে। সে সময় ভাবিনি, আজ আমি এই অবস্থানে থাকব। ১৮ বছরের চেষ্টার পর আলীবাবা আজকের এই আকারে এসেছে। এর কারণ এই নয় যে আমি বিচক্ষণ বা স্মার্ট। বরং আমি মনে করি, আমি বেশ কিছু বিচক্ষণ মানুষের সঙ্গে কাজ করি। তাই সফল হতে হলে আমাদের বিচক্ষণ মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এই সময়কে ঘিরে ভাবলে হবে না। ভাবতে হবে আগামী ১০ বছর পরের সময় নিয়ে। সফল হতে চাইলে আমাদের অনেক অনেক ভুল করতে হবে, তারপরও হার মানা যাবে না। ওই ভুল থেকে অনবরত শিখে যেতে হবে।

যাঁরা ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেন আর নিজের ভুল ও ব্যর্থতা চাপিয়ে দেন অন্যের ঘাড়ে, তাঁরা কখনোই ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পান না। কিন্তু ভুলের পর সেটা স্বীকার করে যাঁরা নিজেকে শোধরান, তাঁদের জীবনে সুযোগ আসে বারবার। তাই জীবনে ব্যর্থ হওয়া মানুষ, ভুল করা মানুষদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখি। নিজের ভুল থেকে আমি অনেক কিছু শিখি। ব্যর্থ হলে আমি নিজেকে বলি, দেখো, আমিও ব্যর্থ হই। সফল হলে বলি, ‘আমি তো ভাবিইনি এভাবে সফল হতে পারব।’

আলীবাবার গল্প

আলীবাবা শুরু করেছিলাম কোনো অর্থ, কোনো বিনিয়োগ, কোনো কর্মী, কোনো কারিগরি সুযোগ–সুবিধা ছাড়া। আমার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ১৮ জন মানুষের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল—আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য কিছু একটা করব। এটাই ছিল আইডিয়া। আলীবাবার জন্ম হয়েছিল চীনে। কিন্তু এটা কোনো চীনা প্রতিষ্ঠান নয়। এর নামটাও কিন্তু চীনা ভাষা থেকে নেওয়া নয়, ১০০১ আরব্য রজনীর গল্প থেকে নামটা নেওয়া। আদতে আলীবাবা হলো চীনে জন্ম নেওয়া একটি প্রতিষ্ঠান, যেটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তরুণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

প্রত্যেক শতকেই এমন একটা প্রতিষ্ঠানের উত্থান হয়, যেটা পুরো শতকের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে। এদের বলা যেতে পারে ‘কোম্পানি ফর দ্য সেঞ্চুরি’। যেমন মাইক্রোসফট ছিল গত শতকের রূপ বদলে দেওয়া কোম্পানি, আইবিএমও তাই। তাহলে একুশ শতকের কোম্পানি কোনটা? বলতে পারেন আলীবাবা। কারণ এর অনেক উপার্জন। বিগত দিনের হিসাব দেখলে বলা যেতে পারে, আলীবাবা অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভবিষ্যতের বিবেচনায় আলীবাবা এখনো অনেক ক্ষুদ্র।

দুই বছর আগে আমি এক রুশ তরুণীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘তুমি কি আলী এক্সপ্রেস (আলীবাবার একটি ই-কমার্স সাইট) ব্যবহার কর?’ মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ, করি।’ জানতে চাইলাম, ‘ওদের ডেলিভারির গতি কেমন লাগে তোমার?’ মেয়েটি জবাব দিল, দারুণ গতি। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, কেমন দারুণ? এবার সে বলল, ‘মাত্র ৪৫ দিনেই আমি আমার পণ্য হাতে পেয়ে যাই।’ কিন্তু আমি তো চাই গ্রাহকের হাতে তাঁর পণ্য ৪৫ দিনে না, ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দিতে। এখন যেমন আমরা ৪৫ দিন থেকে ডেলিভারির সময় ১৫ দিনে নামিয়ে এনেছি। কিন্তু এটাও যথেষ্ট নয়। তাই এখনই নিজেকে সেরা ভেবে ফেললে চলবে না।

ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবো না

ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না। প্রযুক্তি নিয়েও চিন্তার কিছু নেই। ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত হওয়া মানে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। এর মানে হলো, তোমার ভেতর উদ্ভাবনী চিন্তা কমে যাচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতের সংকটগুলোর কোনো সমাধান আমাদের কাছে নেই। কিন্তু কারও না কারও কাছে তো সমাধান আছেই। আমাদের এই প্রজন্মের কাছে আপাতত সমাধান নেই, তবে আমাদের পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের কাছে সমাধান থাকবে। তরুণেরা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হন বৃদ্ধেরা। ভবিষ্যৎ সব সময় সবার জন্য সম্ভাবনাময়। বিশেষ করে তরুণদের জন্য। কারণ তরুণদের কাছে তো হারানোর কিছু নেই। আমি ১৮ বছর আগে নিজেকে এটাই বুঝিয়েছি এবং ঝুঁকি নিয়েছি। ওই তরুণ বয়সে আমার পয়সা ছিল না, তাই অর্থ হারানোর চিন্তাও ছিল না। আমার কোনো প্রযুক্তি ছিল না, তাই সেদিক থেকেও ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না। আমরা শুধু ঠিক করেছিলাম আমরা ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হব। তাই বলছি, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবো না, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হও। নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ বানাও।

আরেকটা বিষয়ও বলতে চাই, অন্যরা যা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে, সেটা নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। বিশেষ করে, রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীরা যা নিয়ে ভাবছেন, সেটাকে নিজের মাথাব্যথা বানানোর মানে হয় না। তোমার নিজের ভাবনার বিষয়গুলো নিয়ে আগে ভাবো। নিজেকে নিয়ে না ভেবে, পুরো দুনিয়াকে নিয়ে ভাবলে দুনিয়া এগিয়ে যাবে, তুমি আর এগোতে পারবে না। তুমি ভাবো, তুমি কবে গ্র্যাজুয়েট হবে। এরপর কীভাবে জীবন চালাবে। এমন কী করবে, যেটা আর সবার থেকে তোমার পরিচয় আলাদা করে তুলে ধরতে পারবে। কোন কাজে তুমি আনন্দ পাও, আগ্রহ পাও। কীভাবে তোমার কাজ দিয়ে অন্যের সাহায্য হবে—তুমি এসব নিয়ে ভাবো।

তাই আমি শেষমেশ বলছি, ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হও। আর প্রস্তুত হতে চাইলে অতীতের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ো না। আগাও বর্তমান থেকে তুমি যা শিখছ, তা নিয়ে। শুধু যন্ত্রের মতো সব মুখস্ত কোরো না। গড়পড়তা শুধু মুখস্ত করে গেলে তোমার আর যন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। চেষ্টা করো সৃষ্টিশীল হতে। নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচর্যা করো। আরও গঠনমূলক হও।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান

সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও