কৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের শিক্ষার্থীরা তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।  ছবি: আবদুস সালাম
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের শিক্ষার্থীরা তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছবি: আবদুস সালাম

কলেজে এসে আনজু জানতে পারে, আগের রাতে তার সহপাঠীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটি প্রচণ্ড ধাক্কা খায় খবরটি শুনে। শোকাহত অন্যরা শোক কাটিয়ে রুটিন জীবনে ঢুকতে পারলেও আনজু স্বাভাবিক হতে পারে না। ক্লাসে অমনোযোগী ও তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে দেখতে পায়, কয়েক যুবক তাকে ধর্ষণের জন্য তাড়া করে ফিরছে। তবে শেষ মুহূর্তে রুখে দাঁড়াল। আত্মরক্ষার বিদ্যার জোরে বেঁচে গেল। শিক্ষকের ডাকে সংবিৎ ফিরে পাওয়া আনজু অনুভব করে, সত্যি এভাবে আক্রমণের শিকার হলে সে তো কিছুই করতে পারবে না। আত্মরক্ষার কৌশলটাই তো তার জানা নেই।

 নারীদের জন্য আত্মরক্ষার ওপর সচেতনতামূলক ‘ওয়ার, উইমেন এগেনইস্ট রেপ’ নামে দক্ষিণ ভারতের একটি ইংরেজি ভাষায় নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে তুলে আনা হয়েছে আনজুর মতো নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা এক মেয়ের কথা। এই আনজু আসলে শহরে-গ্রামে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থান, রাস্তায়, বাজারে, পরিবহনে এমনকি বাড়িতেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা নারীদের প্রতিনিধি। অরুণ কে ভানিইয়ামকুলাম পরিচালিত ওই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে শেষ পর্যন্ত আনজু আত্মরক্ষার কৌশল রপ্তে মাঠে নামে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় মেয়ে বা নারীদের আত্মরক্ষার কৌশলের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ঘটনার পরে অনেকেই আক্ষেপ করছেন, আহা রে, যদি মেয়েটা লড়াই করতে পারত, হয়তো রক্ষা পেত!

 প্রথম আলোতে নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে এক নারী লিখেছেন, একবার রাজধানীর উত্তরায় বাসায় যাওয়ার জন্য তিনি একটি বাসে উঠেছিলেন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে। একপর্যায়ে বাসটিতে তিনি একা হয়ে গেলে চালকের সহকারী তাঁকে চেপে ধরার চেষ্টা করেন। ওই সময় তিনি ব্যাগে লুকিয়ে রাখা ছোট ছুরি দিয়ে সহকারীকে আঘাত করে চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়।

গত বছর শুধু ঢাকার বিচারিক আদালতে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৯টি।

গণপরিবহনে যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু সতর্কতামূলক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। তবে গণপরিবহন থেকে শুরু করে সব জায়গায় নিজেকে রক্ষার জন্য সতর্ক থাকার পাশাপাশি যদি আঘাত আসেই, তাহলে পাল্টা আঘাত দেওয়ার জন্য আত্মরক্ষার কৌশল শেখার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছেন অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সংগঠন বিনা মূল্যে, আবার কোনো কোনো সংগঠন নামমাত্র মূল্যে শেখাচ্ছে আত্মরক্ষার নানা কৌশল। বিভিন্ন সংগঠন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় গিয়েও আত্মরক্ষার কৌশল শেখাচ্ছে।

আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোর একটি সংগঠন হচ্ছে স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স বাংলাদেশ (শি)। সংগঠনটি ‘বি লাইক তারামন বিবি’ (তারামন বিবির মতো হও) শিরোনামে স্কুল পর্যায়ে শুধু মেয়েদের বিনা মূল্যে লাঠি চালানোসহ আত্মরক্ষার কৌশল শেখায়। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শারমিন ফারহানা চৌধুরী বলেন, ‘অনেক কর্মজীবী নারীকে রাতে বাড়ি ফিরতে হয়, অনেক মেয়েকে পথে একা চলতে হয়। তাঁদের আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে আমরা শেখাই প্রতিবাদ কর, প্রতিহত কর।’

শারমিন ফারহানা চৌধুরী জানালেন, গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির আওতায় সাভারের এব্যাক পাবলিক স্কুল এবং মিরপুরের ইউসেপ স্কুলে আড়াই শ মেয়েকে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হয়েছে। সারা দেশেই এ ধরনের কর্মসূচি পরিচালনার পরিকল্পনা আছে।

তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণে ব্যস্ত এক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হয়। ছবি: প্রথম আলো
তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণে ব্যস্ত এক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হয়। ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি সংস্থায় গিয়ে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে জুডো ও কারাতে শেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টার। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে (বৃহস্পতিবার বিকেলে ও শুক্রবার সকালে ছাড়া) পাঁচ দিন ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাচে বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দেন ২০ জন প্রশিক্ষক। ২০০০ সাল থেকে সেন্টারটি যাত্রা শুরু করলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ২০০৭ সালে। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০–এর মতো ছেলেমেয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

 ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টার সেন্টারের উপপরিচালক নয়না চৌধুরী বলেন, একা পথ চলতে গিয়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাসী হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আত্মরক্ষার কৌশল জানা থাকলে একজন নারী অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। আত্মবিশ্বাসী হলেই শত্রুপক্ষকে আঘাত করতে নিজের শেখা কৌশলকে কাজে লাগাতে পারবেন।

 ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত জুডো ও কারাতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে সদ্য পাস করা সুমাইয়া তাসনিম। তিনি বলেন, ‘আমার এখন নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত মনে হয়। আমার আত্মবিশ্বাস হামলাকারীকে আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগাবে।’

বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম জানালেন, ২০১৩ সাল থেকে দেড় লাখ শিক্ষার্থী তাঁদের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এখন ঢাকাসহ পাঁচ জেলার ৭০-৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী মাসে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন।

মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আত্মরক্ষার কৌশল শেখার সবচেয়ে বড় উপকারিতা হচ্ছে এটা সাহসী হতে শেখায়, জড়তা কাটায় এবং যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলে। আমরা প্রথমে শেখাই ঘটনা থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে। শুরুতেই মারামারি করার মতো পর্যায়ে যাওয়া যাবে না। যখন আর কিছু করার থাকবে না, তখন শেষ হাতিয়ার হিসেবে লড়তে হবে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এতে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রতিরোধ করা শতভাগ সম্ভব।’

গণপরিবহনসহ রাস্তাঘাটে নিরাপদ থাকার কৌশল হিসেবে এখন বিভিন্ন বয়সী নারী স্কুটি চালানো শিখছেন বলে জানালেন ‘যাব বহুদূর’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও টিম লিডার আতিকা রোমা। তিনি বলেন, অনেকেই নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে গণপরিবহনে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে ভয়ও পাচ্ছেন। ফলে নারীরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজস্ব বাহনের দিকে ঝুঁকেছেন। আতিকা রোমা জানালেন, তাঁর সংগঠন থেকে সাড়ে চার শ নারী স্কুটি চালানো শিখেছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নারীকে এখন নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লড়াই নিজেকেই করতে হবে। নারীর ওপর ঘটে চলা নির্যাতন বন্ধ করতে এ ধরনের আত্মরক্ষার কৌশল বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজে দেবে।