কিছু গুণ ডিগ্রির চেয়ে দামি : জেনিফার লোপেজ

>
জেনিফার লোপেজ
জেনিফার লোপেজ
জেনিফার লোপেজের বয়স ৫০ হয়েছে। কিন্তু এই বয়সেও তিনি দিব্যি মঞ্চে, সিনেমায় আর ব্যবসাক্ষেত্রে সমানতালে ব্যস্ত। গত সপ্তাহেই ‘সুপারবোল হাফটাইম শো’-তে লাতিন সংগীততারকা শাকিরার সঙ্গে ১৪ মিনিটের একটি পরিবেশনা দিয়ে নতুন করে উঠে এলেন আলোচনায়। প্রভাবশালী উদ্যোক্তা হিসেবেও এরই মধ্যে ফোর্বস সাময়িকী জেনিফারকে দিয়েছে স্বীকৃতি। ২০১৮ সালে লিংকডইন-এর এডিটর ইন চিফকে সাফল্য, ব্যর্থতা ও প্রত্যাখ্যান নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন জেলো (জেনিফারের ডাকনাম)। সেই সাক্ষাৎকারে বলা কিছু কথা থাকল আজ।

প্রত্যাখ্যান নিয়ে...

প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন একজন এগিয়ে যেতে চায়, নিজের লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে চায়। যখন একজন চায় নিজেকে ছাপিয়ে যেতে, আরও একটু সফল হতে। কিন্তু কোথাও গিয়ে আমরা মাঝেমধ্যে আটকে যাই। আমরা তখন জানি না যে কীভাবে সেই বাধা টপকে এগিয়ে যাব। কিন্তু শেষে গিয়ে একসময় আমরা ঠিকই বুঝতে পারি, প্রতিবন্ধকতা আদতে আমি নিজেই। মন থেকে চাইলে আমরা আমাদের সামনে আসা প্রতিটি বাধাকেই উতরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখি। হ্যাঁ, লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা লম্বা হতে পারে, সফর কঠিন হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়। আমার জীবনে এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতা হয়েছে। কারণ এই বিনোদনের দুনিয়া কাউকে কোনো ছাড় দেয় না। প্রত্যাখ্যান এখানে রোজকার বিষয়। আমি প্রায় ৪০টির মতো সিনেমা করেছি। এর মধ্যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি কম করে হলেও ১০০ বার, না না ৪০০ বার তো হবেই।

কলেজ ডিগ্রি নিয়ে...

কারও যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তি শক্ত হয়, তাহলে সেটা খুবই ভালো ব্যাপার। তবে আমি আমার জীবন এবং আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা দেখে বলতে পারি যে নিজের যোগ্যতা তুলে ধরা ও মূল্যায়নের জন্য কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না। বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী চিন্তা—এসব ব্যক্তির ভেতরে-ভেতরে চর্চা করতে হয়। আর এই গুণগুলো যেকোনো ডিগ্রির চেয়ে অনেক দামি। অনেক মেধাবী মানুষই উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না। আমি যেমন পাইনি, আমার আশপাশে যাঁরা বেড়ে উঠেছেন তাঁরা পাননি, কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু আজ প্রতিষ্ঠিত ও সফল।

আমি একজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে বলতে পারি, আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি ডিগ্রিধারীদের খুঁজি না। আমি দেখি একজনের ভেতরে কাজের স্পৃহা ও শক্তিকে। সত্যি বলতে আমি কঠোর পরিশ্রমী লোক খুঁজি সব সময়। এমন পরিশ্রমী হতে হবে যে দিনে ২৪ ঘণ্টা কাজ করতেও ভয় পায় না। শুনতে উদ্ভট লাগতে পারে, কিন্তু আমরা এমনই। আমি এমন, আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তাঁরাও এমন।

জেনিফার লোপেজ
জেনিফার লোপেজ

না বলতে শেখা...

একটা সময় ছিল যখন ‘না’ বলা আমার জন্য খুবই কঠিন একটা কাজ মনে হতো। আমি সব সময় নিজের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি দায়িত্ব নিজের ওপর নিয়ে নিতাম। কারণ আমি একজন কাজপাগল মানুষ। আমি একসঙ্গে অনেক কিছু করতে ভালোবাসি। আমি অভিনয় করতে ভালোবাসি, আমি সিনেমা বানাতে ভালোবাসি, আমি টিভি প্রযোজনাও ভালোবাসি। আমি মঞ্চে পারফর্ম করতে ভালোবাসি, আমি কনসার্ট করতে ভালোবাসি। আবার আমি গান বাঁধতে ভালোবাসি, স্টুডিওতে বসে কাজ করতেও ভালোবাসি। তাই যখন এর মধ্যে কোনো একটা কাজের সুযোগ আমার হাতে আসে, আমি সেটা ছাড়তে পারি না, সেটাকে ‘না’ বলতে পারি না। আমার জন্য না বলা খুব কঠিন। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে আমি শিখছি এবং জীবনের এই পর্যায়ে এসে একটু একটু করে ‘না’ বলার চেষ্টা করতে শুরু করেছি। আমি এখন বুঝতে পারি, সারাক্ষণ কাজ করার চেয়ে, বুদ্ধি খাটিয়ে সেরা কাজটা করাই শ্রেয়। নয়তো জীবনের ওপর ক্লান্তি চেপে বসতে পারে।

সেরা কাজ বেছে নেওয়া...
আমি কাজ বা প্রকল্প বাছাই করি এর মান দেখে। শুরুতেই আমাকে বুঝতে হবে যে কোন কাজ বা প্রকল্প থেকে বিনিয়োগের চেয়ে বেশি উঠে আসতে পারে। আমি সেই কাজ থেকেই বিনিয়োগের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ তুলে আনতে পারব, যেই কাজ আমি ভালোবেসে করতে পারব। প্রথমেই আমাকে দেখতে হবে কোন প্রকল্পকে আমি ভালোবাসতে পারি, কোনটার সঙ্গে আমি নিজের চিন্তাকে মেলাতে পারি, কোন কাজটায় যুক্ত হলে আমার শিল্পীমন ভেতর থেকে গেয়ে ওঠে। প্রকল্প বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়া শিখতে গিয়ে আমাকে জীবনের অনেক লম্বা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। তারপর গিয়ে ব্যাপারটা আয়ত্তে আনতে পেরেছি। আর এ জন্যই আমি আজ এমন এক অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি, যেখানে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা অনেক স্থিতিশীল আর নির্দিষ্ট।

জীবনের প্রতিকূলতা নিয়ে...

আমি জীবনে অনেকবার হোঁচট খেয়েছি, আটকে গেছি। কিন্তু এখন সেই দিনগুলোর দিকে তাকালে আমি নিজেকে বলি, ‘বাহ, দারুণভাবে এগিয়ে এসেছি তো!’ এটাই হচ্ছে আসল মন্ত্র। কখনো থামা যাবে না। সব সময় চলার মধ্যে থাকতে হবে। হোঁচট খাওয়া, ভুল করা, বাজে সিনেমায় অভিনয় করা, ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া—এগুলো কোনোটাই ব্যর্থতা নয়। ব্যর্থতা হলো থেমে যাওয়া। হোঁচট খাওয়ার পরও আবার উঠে দাঁড়ালে, তখন তুমি ব্যর্থ না। এগিয়ে না গেলে, তুমি ব্যর্থ।

আমরা অনেক সময় আমাদের নিজের মনের কথাটা শুনি না। সঠিক সময়ে আমাদের মন যা বলছে, সেটা আমরা মানতে চাই না। বেশির ভাগ সময় এমনটা আমরা করি ভয় থেকে। আর এটাই আমাদের দুর্দশার দিকে নিয়ে যায়। আমার মনে হয়, প্রতিকূল মুহূর্তে আমাদের সব সময় মনের কথা শোনা উচিত। বুঝতে না পারলে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, আমি কি ভয় পেয়ে নিজের মনের কথা শুনছি না? এই প্রশ্নের জবাবের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ।

সাফল্যের টোটকা...

সাফল্যের কোনো ধরাবাঁধা সূত্র বা কৌশল নেই। সফলতার দিকে একেকজনের যাত্রা, একেকজনের পথ একেক রকম। আমি এমন কোনো অভিনেতার সঙ্গে কথা বলিনি যে কি না আমাকে একদম ধরে ধরে বলে দিয়েছে যে ‘আমি প্রথম অভিনয়ের স্কুলে গিয়েছি। তারপর মঞ্চনাটক করেছি। তারপর টেলিভিশনে কাজ পেয়েছি। সিনেমায় গেছি এর পরের ধাপে।’ এমন সূত্র মেনে কখনোই কিছু হয় না। আমি যে শুরু করেছিলাম নৃত্যশিল্পী হিসেবে। ভেবেছিলাম আমি বুঝি এরপর মঞ্চে কাজ করার সুযোগ পাব। কিন্তু সেই অনুযায়ী কিছুই হয়নি। আমি এরপর কয়েকটা অনুষ্ঠানে নাচ করি। এরপর ফিরে এসে একটা টিভি অনুষ্ঠানে ছোট্ট একটা চাকরি পাই। এরপর শুরু করি অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা। সেখান থেকে আমি আমার নিজের প্রথম টিভি শোর কাজ পাই। এরপর কাজ করি সিনেমায়।

আমি একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজকের জায়গায় এসেছি, তবে সেই প্রক্রিয়াটা কখনোই আমি পরিকল্পনা করে সাজিয়ে এগোতে পারিনি। এই প্রক্রিয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের গতিতে এগিয়েছে। উপদেশ হিসেবে যেটা দিতে পারি সেটা হলো, একজনকে সবার আগে ঠিক করতে হবে নিজের লক্ষ্যটা। ‘আমি কোথায় যেতে চাই?’ এই প্রশ্নের জবাব নিজের মধ্যে স্থির করতে হবে, এরপর সেই লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন একটু একটু করে এগোতে হবে। এর পাশাপাশি এই যাত্রায় প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও উন্নত ও পরিণত করতে হবে। এরপর তোমার পথ তোমাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা আমি বলতে পারব না, তুমিও না। আমি শুধু বলতে পারি, প্রতিদিন যদি তুমি নিজেকে তোমার লক্ষ্যের কথা মনে করিয়ে দাও, আর সেই লক্ষ্যের দিকে ছুটতে থাকো, তোমার অর্জন কোনো অংশেই কম হবে না, বেশিই হবে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান

সূত্র: লিংকড–ইন