আমার ক্যামেরায় আমার বই

নিজের এই প্রিয় বই দিয়েই এ ধরনের ছবি তোলা শুরু করেছিলেন জান্নাতুল
নিজের এই প্রিয় বই দিয়েই এ ধরনের ছবি তোলা শুরু করেছিলেন জান্নাতুল

সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’ ছড়াটা যদি পড়ে থাকেন, তাহলে হাঁসজারু, জিরাফড়িং কিংবা বকচ্ছপ প্রাণীগুলো আপনার কাছে অচেনা হওয়ার কথা নয়। হাঁস আর শজারু মিলে হয়েছিল হাঁসজারু, জিরাফ আর ফড়িং মিলে জিরাফড়িং...। কেউ যদি বই পড়তে আর ছবি তুলতে ভালোবাসেন, তাঁকে কী বলবেন? পাঠক ও আলোকচিত্রী—দুইয়ে মিলে আলোকচিত্রী কি বলা যায়?

বিভিন্ন ক্যাম্পাসে এমনই কয়েকজন তরুণকে আমরা খুঁজে পেয়েছি; যাঁরা একই সঙ্গে বইপ্রেমী, আবার ছবি তোলার প্রতি একটা আগ্রহ আছে। চলুন, পরিচয় করিয়ে দিই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিক খান। বই পড়তে ভালোবাসেন। পড়া হলে সেসব বই নিয়ে গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। একদিন খেয়াল করলেন, বিদেশি ভাষার কিছু বইয়ের ‘থিমভিত্তিক’ ছবি আছে। বিষয়টা মনে ধরে গেল সাদিকের। মাথায় ঘুরতে থাকল আইডিয়া। মূলত সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি হাতে তুলে নিলেন ক্যামেরা আর বই। তুলতে শুরু করলেন নান্দনিক সব বই-ছবি।

সাদিকের বই-ছবি ফেসবুকে ভালোই প্রচার পায়। বিষয়টা আরও স্পষ্ট হয় সিলেটের এমসি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী ফৌজিয়া লিমার কথায়। কারণ, ফৌজিয়ার বই-ছবি তোলা শুরু সাদিকের কাজ দেখে। তিনি বলছিলেন, ‘মাথায় এ রকম কিছু ছিল। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। সাদিক ভাইয়ার কাজ দেখেই নেমে পড়লাম।’ চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়ুয়া তিনি। প্রতিদিন কিছু না কিছু তাঁকে পড়তেই হবে। এ ছাড়া নাকি তাঁর চলেই না!

নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করা রিমা শারমিনের গল্পটা আবার ভিন্ন। শুরুতে শুধু শাড়ি পরে ছবি তুলতে ভালোবাসতেন, একসময় ভাবলেন, নিজের পড়া বইগুলোর নান্দনিক ছবি তুলে রাখলে কেমন হয়? এই ভাবনা থেকেই তাঁর ছবি তোলা শুরু।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাদিক তোলেন বইয়ের থিমভিত্তিক ছবি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাদিক তোলেন বইয়ের থিমভিত্তিক ছবি

তিনজনের শুরুর গল্প শোনা হলো। তাঁদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ জান্নাতুল ফেরদৌসের যেন নিজের গল্প বলার জন্য তর সইছিল না। নিজ উদ্যোগে বলা শুরু করলেন, ‘বইয়ের ছবি তুলি মূলত ছুটিতে বাসায় গেলে। হলে থাকলে ছবি তোলার জন্য সময় এবং ঠিকঠাক উপকরণ পাওয়া যায় না। তো বাসায় গেলে আমার কয়েকটা কাজ থাকে। বই পড়া, মুভি দেখা, পছন্দের উক্তিগুলো ডায়েরিতে লেখা আর বই নিয়ে ছবি তোলা। একদিন নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে “বিজয় দিবস” থিম নিয়ে কিছু ছবি দেখলাম। তখন আমার কাছে এম আর আখতার মুকুলের আমি বিজয় দেখেছি বইটা ছিল। ভাবলাম আমিও চেষ্টা করি। সেই বইয়ের প্রচ্ছদের সঙ্গে মিলিয়ে ছবি তুলতে গিয়েই বলতে পারেন শুরু। এরপর থেকে কোথাও গেলে ব্যাগে বই থাকে। পছন্দসই লোকেশন পেলে ছবি তুলি।’ এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই ছাত্রী।

বই-ছবির এই চর্চা আমাদের দেশে শুরু হয়েছে বেশি দিন হয়নি। যাঁরা ছবি তোলেন, তাঁরা আনন্দ পান। তবে বিরূপ মন্তব্যও আসে। কেউ বলেন, ‘সবই ভাইরাল হওয়ার ধান্দা।’ কেউ বলেন, ‘বই পড়েন কখন, আর ছবি তোলেন কখন?’ এসবে পাত্তা দেন না এই পাঠকচিত্রীরা। তাঁদের ভাষায়, নতুন কিছু শুরু হলেই সেটা নিয়ে নেতিবাচক কথা বেশি হয়। তাঁরা বইয়ের নাম, বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিতে চান। তবু বই নিয়ে কথা তো হোক।

রিমা শারমিনের ছবিতে থাকে নানা আয়োজন
রিমা শারমিনের ছবিতে থাকে নানা আয়োজন

বইয়ের ছবি তুলতে গিয়েও কিন্তু নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়। জান্নাতুল ফেরদৌস বললেন, ‘কয়েক দিন আগে চাঁদপুরে গিয়েছিলাম। ভাবলাম দুটি বই সঙ্গে নিয়ে যাই। পলা হকিন্সের ইনটু দ্য ওয়াটার আর হুমায়ূন আহমেদের একটা বই নিলাম। ওখানে গিয়ে ইনটু দ্য ওয়াটার–এর ছবি তুললাম। আমার দেখাদেখি এক বন্ধু বলল, সে-ও বইয়ের একটা নান্দনিক ছবি তুলবে।ছবি তুলতে গিয়ে সে বই ফেলে দিল পানিতে। আমার বই তখন সত্যি সত্যিই ইনটু দ্য ওয়াটার! মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’

বই পড়তে ও ছবি তুলতে ভালোবাসেন ফৌজিয়া লিমা
বই পড়তে ও ছবি তুলতে ভালোবাসেন ফৌজিয়া লিমা

ফৌজিয়া লিমাও তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। তিনি ওবায়েদ হকের নীল পাহাড় জলেশ্বরী বইয়ের ছবি তোলার জন্য গিয়েছেন সিলেটের সাদা পাহাড় ও বিছনাকান্দি। ‘মাথায় ভূত না থাকলে এই কাজ কেউ করে বলেন?’ বলে নিজেই একচোট হেসে নিলেন ফৌজিয়া।

রিমা শারমিনের বই-ছবিকে বলা চলে ‘প্রাকৃতিক ও রহস্যগন্ধী’। তাঁর তোলা ছবিতে কী নেই! দা, বঁটি, লাউ, কুমড়া, চা, কফি, টুথপেস্ট...নানা কিছু ব্যবহার করেন তিনি। অন্যদিকে সাদিক খান শোনালেন আরেক গল্প। একটা বইয়ের ছবি তোলার জন্য বিয়েবাড়ি দরকার ছিল তাঁর। এক বান্ধবীর বিয়েতে সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলেন। দুটি বই নিয়ে গিয়েছিলেন। বান্ধবী দুটি বই-ই রেখে দিয়েছেন উপহার হিসেবে। তাতে অবশ্য সাদিক খুশিই হয়েছেন। বই উপহার দেওয়ার মধ্যেও যে আনন্দ আছে।