দল বেঁধে মাঠে চাকরির পাঠে

দিনাজপুর সরকারি কলেজের মাঠে এভাবেই দল বেধে পড়েন তরুণেরা। পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন উত্তর বলছেন, বাকিরা মিলিয়ে নিচ্ছেন। ছবি: রাজিউল ইসলাম
দিনাজপুর সরকারি কলেজের মাঠে এভাবেই দল বেধে পড়েন তরুণেরা। পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন উত্তর বলছেন, বাকিরা মিলিয়ে নিচ্ছেন। ছবি: রাজিউল ইসলাম

দিনাজপুর সরকারি কলেজের মাঠজুড়ে বসে ছিলেন কয়েক শ শিক্ষার্থী। ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০টি দল তো হবেই। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে তাঁরা শীতের সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। কাছে গেলে ভুল ভাঙবে। বোধ হয় একটু অবাকও হবেন।

৬ ফেব্রুয়ারি, বেলা ১১টা। কলেজমাঠে গোল হয়ে বসেছিল, এমন প্রায় ৪০ জনের একটি দলের কথাই বলি। সবার হাতে বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্রের ফটোকপি। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন বলে যাচ্ছিলেন, ‘৫৩–এর ২, ৫৫–এর ৪, ৫৬–এর ২...’। লাল কলম হাতে বাকিরা টিক দিচ্ছিলেন নিজ নিজ উত্তরপত্রে। কথা বলে জানলাম, এই তরুণেরা সবাই চাকরিপ্রত্যাশী। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি তাঁরা নেন দল বেঁধে। ইংরেজিতে যাকে বলে গ্রুপ স্টাডি। কৌতূহল নিয়েই আলাপ শুরু করেছিলাম। তখনো জানতাম না, আমাদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছে আরও

ছয় থেকে ছক্কা

পড়ালেখার এই দলগুলোর আলাদা নাম আছে, আছে প্রাতিষ্ঠানিক পদও। মাঠজুড়ে গোল হয়ে বসে থাকা দলগুলোর মধ্যে যে দলটা সবচেয়ে বড়, তার নাম ‘গ্রুব অব ক্রিয়েটিভিটি’ (জিওসি)। বোঝা গেল নামকরণেও তাঁরা সৃজনশীলতার পরিচয় দেন। দলের চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার রায়ের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, জিওসি যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৩ সালে। বর্তমানে এই দলের সদস্য সংখ্যা ১১২। ৫ জনের পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে গ্রুপটি চলছে। এই দলের প্রায় সবাই-ই দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয়েছেন। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষার্থীও আছেন।

চাকরির প্রস্তুতির জন্য এই তরুণেরা নিজেরাই তৈরি করেছেন সিলেবাস। সেই সিলেবাস অনুসারে সপ্তাহের চার দিন দুই ঘণ্টা করে নিয়মিত গ্রুপ স্টাডি করেন তাঁরা। এর মধ্যে এক ঘণ্টা থাকে আলোচনা, আর বাকি সময়টা পরীক্ষা। প্রতি ক্লাসে একজন প্রশ্ন তৈরি করার দায়িত্ব নেন। যেদিন যাঁর প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা হয়, সেদিন তাঁর পরীক্ষা দেওয়া হয় না। এভাবে একে অন্যের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। সবচেয়ে বেশি নম্বর প্রাপ্তকে দেওয়া সামান্য উপহার। নিজেরাই প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদা দেন দলের সদস্যরা। সেই টাকায় প্রশ্ন ফটোকপি করা, পুরস্কার কেনা ছাড়াও কখনো কখনো করা হয় সবার জন্য নাশতার বন্দোবস্ত।

এখানে চাকরিপ্রত্যাশীরা নিজেরাই নেন নিজেদের পরীক্ষা। ছবি: লেখক
এখানে চাকরিপ্রত্যাশীরা নিজেরাই নেন নিজেদের পরীক্ষা। ছবি: লেখক

২০১৩ সালে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রঞ্জন কুমার রায় তাঁর ছয়জন বন্ধু নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এই জিওসি গ্রুপ। সেই ছয়জনই কিন্তু এখন ভালো চাকরি করছেন। যেমন রঞ্জন কুমার ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় নন–ক্যাডার পদে চাকরি পেয়ে এখন ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জামালপুর জেলার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করছেন হীরক কুমার দাস। তিনি বলেন, ‘স্নাতক শেষ করার পরে চাকরির কোচিং করতে কয়েকজন বন্ধু মিলে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। প্রত্যেকের জন্য আট হাজার টাকা চেয়েছিল কোচিং ফি। সবাই ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের। পরিবার থেকে একসঙ্গে এত টাকা নেওয়া সম্ভব ছিল না। সেদিন রাতেই সাত বন্ধু মিলে নিজেরাই গ্রুপ স্টাডি করার সিদ্ধান্ত নিই।’

হীরকেরা তখনো জানতেন না, তাঁদের দেখানো পথে হেঁটে একদিন এই দিনাজপুর সরকারি কলেজের ফুটবল মাঠে সপ্তাহে চার দিন চাকরির পড়ালেখার হাট বসবে। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা আত্মার বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা আজও বহন করে চলেছি। একজনের বিপদে অন্যজন এগিয়ে এসেছি। এভাবে গ্রুপ স্টাডির ফলে চাকরির প্রস্তুতির পাশাপাশি বেশ কিছু বড় বড় কবি–সাহিত্যিকদের বইও পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। গ্রুপ স্টাডিতে না এলে তখন আর ভালো লাগত না।’

আত্মবিশ্বাসের দাওয়াই

গ্রুপ স্টাডির ফলে অনেকের কাছে সাফল্য যেমন ধরা দিয়েছে, তেমনি আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে অনেক। জিওসি গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার জানালেন, এই দল থেকে ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় তিনজন উত্তীর্ণ হয়েছেন। ৩৮তম মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন ১২ জন, ৪০তম লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন ১৬ জন। ২০১৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরি হয়েছে ১৭ জনের এবং ২০১৯ সালে চাকরি পেয়েছেন ২৬ জন। এ ছাড়া ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেছেন ১৩ জন। যাঁরা চাকরি পেয়ে যান, দলের পক্ষ থেকে তাঁদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয়।

গ্রুপের সদস্য সবিতা রানী, অক্ষয় কুমার রায়, অলেশ্বর রায়, সুরুজ্জামানসহ অনেকেই জানালেই, দল বেঁধে পড়াশোনার সুফল তাঁরা পাচ্ছেন। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, এক বছরের প্রস্তুতিতেই এখন যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মতো সাহস তাঁরা অর্জন করে ফেলেছেন। একা একা পড়লে এত দিনে হয়তো হতাশায় পেয়ে বসত।

দলের কেউ চাকরি পেলে তাঁকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। ছবি: সংগৃহীত
দলের কেউ চাকরি পেলে তাঁকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। ছবি: সংগৃহীত

জিওসিতে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থী বাদল আশরাফ। ২০১৮ সালে এমএস ইন সার্জারি শেষ করেছেন তিনি। দুচোখে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন, তাই অন্য কোনো পরীক্ষায় তেমনভাবে অংশগ্রহণ করেননি আজ অবধি। ৩৮ ও ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশও নিয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগ হয়নি। গ্রুপের সদস্য, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থী প্রশান্ত কুমার তাঁর বন্ধু। প্রশান্ত ৩৭তম বিসিএসে নন–ক্যাডার পদে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে সুযোগ পেয়েছেন। তাঁরই পরামর্শে বাদল প্রায় সাত মাস ধরে জিওসির সদস্য। বাদল বলেন, ‘এত দিন নিজে নিজে পড়াশোনা করেছি। দিনরাত পড়তাম, কিন্তু নিজের ভুলগুলো ধরতে পারতাম না। গ্রুপ স্টাডির মাধ্যমে এই কদিনে অনেক ভালো প্রস্তুতি নিতে পেরেছি।’ বাদলের বিশ্বাস, আগামী বিসিএস পরীক্ষার পর তিনি একটা সুখবর দিতে পারবেন।

পড়তে পড়তে পরিবার

জিওসির সদস্যদের কার্যক্রম শুধু পড়ালেখায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। রুটিনমাফিক একসঙ্গে পড়াশোনা করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে তৈরি হয়েছে একটা অন্য রকম বন্ধন। একে অপরের বিপদে-আপদে তাঁরা সহযোগী হয়ে উঠছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি দল বেঁধে যুক্ত হয়েছেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। প্রত্যেকের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা আছে। দিনাজপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে কারও রক্তের দরকার হলেই জিওসি গ্রুপের সদস্যরা এগিয়ে আসেন। বার্ষিক বনভোজন আয়োজন করেন নিয়মিত। নিজেরাই বিষয় নির্ধারণ করে মাসে একবার বিতর্কের আয়োজন করেন। তবে বর্ষা মৌসুমে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের। মাঠ চলে যায় কাদাপানির দখলে। কখনো কখনো কলেজ ভবনের সিঁড়িতে বসেন পড়েন তাঁরা।

দিনাজপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদুল হকের সঙ্গে এই গ্রুপ স্টাডির প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিনির্ভর শিক্ষার কথা মনে করিয়ে দিলেন। সঙ্গে বললেন, ‘বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তা ছাড়া জ্ঞান অর্জনের বড় একটা কৌশলই হচ্ছে গ্রুপ স্টাডি।’ তবে প্রতিযোগিতার চাপে পড়ে একাডেমিক পড়ার চেয়ে চাকরির পড়ায় শিক্ষার্থীরা বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন তিনি। বলছিলেন, ‘বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে শিখছে, এটা ভালো। কিন্তু চাকরির পরীক্ষাপদ্ধতি কিংবা একাডেমিক সিলেবাসের পরিবর্তন প্রয়োজন। দুটি বিষয়ের সমন্বয় না হলে একাডেমিক শিক্ষা শুধু সনদপ্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।’