'বন্ধ্যা' শব্দটি পিছু ছাড়েনি

আলআমিন একজন উদ্যোক্তা। তবে তিনি একজন ‘পালক’ ছেলে—এ পরিচয় অন্য পরিচয়কে পেছনে ফেলে দেয়। অন্যদিকে পালক ছেলের মা ফরিদা পারভীনকে আশপাশের মানুষই মনে করিয়ে দেয়, তিনি একজন ‘বন্ধ্যা’ নারী। মনে করিয়ে দেয়, তিনি আর একটা কলাগাছের মধ্যে সেভাবে কোনো তফাত নেই।

 বয়স ২৮ পেরিয়েছে আলআমিনের। দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন। আলআমিন ও তাঁর মা ‘বন্ধ্যা’ শব্দটির বিরুদ্ধে লড়তে চান। ফরিদা সুই-সুতা দিয়ে বিছানার চাদরে ফুল তুলতেন। হাতপাখা বুনতেন। বাঁশের মোড়াসহ কত কিছু তৈরি করতেন। এ পর্যন্ত ১০০টির বেশি স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবে সহায়তা করেছেন। মৃত মানুষকে গোসল করাতে পছন্দ করেন। জীবনে নার্স হতে চেয়েছিলেন। অথচ ফরিদা পারভীন শুধু ‘বন্ধ্যা’ শব্দটি যাতে শুনতে না হয়, তাই ঘরের চার দেয়ালের গণ্ডির মধ্যে ঢুকে গেছেন বা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছেন।

 প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসেই কথা হলো এই মা ও ছেলের সঙ্গে। পাশাপাশি বসা মা-ছেলে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমরা মা ও ছেলে এখন ভালো আছি। কে কী বলল, তা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে চাই না। আমরা চাই শুধু কেউ মা হতে না পারলে সমাজের মানুষ যেন একটু চুপ থাকে।’

১৯৮০ সালে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে। স্বামী পুলিশের সেপাই ইস্কান্দার আলী তালুকদারের সঙ্গে যশোর, রাঙামাটি, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় থাকতে গিয়ে আর পড়াশোনা হয়নি ফরিদা পারভীনের। সন্তানের মা হতে না পারার যন্ত্রণাও যোগ হয়।

আলআমিনকে ছেলে হিসেবে পাওয়ার গল্প শোনালেন ফরিদা পারভীন। বরিশালে আলআমিনের ১১ দিন বয়সে তিনি ফরিদা পারভীনের কোলে এসেছিলেন। একসঙ্গে এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দেওয়ার পর আলআমিনের মা ও যমজ বোনটি মারা যায়। আলআমিনের বাবা আলআমিনকে ফরিদা পারভীনের নানির কাছে দিয়ে যান।

ফরিদা পারভীন বললেন, ‘দুধ না থাকলেও ছেলেকে বুকে নিয়ে চুষতে দিতাম।’ জানালেন, প্রথম দিকে ছেলের বাবা মানতে পারছিলেন না। ছেলে পেলেও মানুষের কথা থেকে তো মুক্তি মেলেনি। রাস্তায় বের হলে কোনো না কোনোভাবে আঁটকুড়ে, বাঁজাসহ নানান কথা শুনে বাড়ি ফিরতে হতো। দ্বিতীয় বিয়ের জন্যও চাপ ছিল।

মা ফরিদা পারভীন ও ছেলে আলআমিন।  ছবি: প্রথম আলো
মা ফরিদা পারভীন ও ছেলে আলআমিন। ছবি: প্রথম আলো

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক স্বজনই আলআমিনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি পালক ছেলে। বর্তমানে চাকরি থেকে অবসর নেওয়া বাবার কথা উল্লেখ করে আলআমিন বলেন, ‘আব্বু রাগ করলেও মায়ের আর আমার হাত ছাড়েননি কখনো। অন্যদিকে আমি আমার কষ্টের কথা আম্মুকে বলতাম না, আম্মুও আমাকে কিছু বলত না। কিন্তু দুজনেই মানুষের কথায় দগ্ধ হতাম।’

ছেলের সঙ্গে স্কুলে গেলে শুনতে হতো নানা কথা। তাই স্কুলে যাওয়া বাদ দিলেন। অন্যদিকে, ছেলেকেও প্রায় সময় স্কুল থেকে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতে হতো। মনের কষ্টে মাঝেমধ্যে ছেলেকেই পেটাতেন, পরে নিজেই কান্নাকাটি করতেন। আর আলআমিন বললেন, ‘মানুষের কথা থেকে বাঁচার জন্য কানে মুঠোফোন নিয়ে রাস্তায় বের হতাম, স্কুল, কলেজ বা নির্দিষ্ট গন্তব্যে গিয়ে কান থেকে ফোন নামাতাম। সবাই ভাবত আমি ফোনে কথা বলছি।’

ফরিদা পারভীন বললেন, ছেলেকে যাতে ঘরের বাইরে কম যেতে হয়, সে জন্য ঘরের মধ্যেই ছবি আঁকা, নাচ শেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যস্ত রাখতেন। আর ঘরে বেশি সময় থাকতে গিয়ে ছেলে মায়ের কাছ থেকে হাতের কাজ শিখে গেলেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না করে হাতের কাজটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। মা আর ছেলে মিলে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন, তারপর আলআমিন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মেলায় অংশ নিয়ে তা বিক্রি করেন। নিজের শহর বাদ দিয়ে ময়মনসিংহে হস্তশিল্পপণ্য বিক্রির একটি দোকান দিয়েছেন আলআমিন।

আলআমিন বলেন, ‘মা একদিন মেরেছিলেন। এক স্বজন জানিয়ে দিলেন, তুমি তো তোমার মায়ের পালক ছেলে, নিজের ছেলে হলে তো মারতেন না। মাঝেমধ্যে নিজের ক্ষতি করতে চাইতাম। দিনে ১০ বারও এ ধরনের কথা শুনতে হতো। এই ধাক্কা সামলাতে সামলাতে শুরু হলো আমি সম্পত্তি পাব না। আর এখন শুরু হয়েছে ছেলে হয়েও আমি কেন মেয়েদের মতো বিভিন্ন জিনিস তৈরি করি।’

ফরিদা পারভীন জানান, তাঁর হাতেই জন্ম নেওয়া নিজের বোনের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে বিয়ে করানোর আগে আইন অনুযায়ী পরিবারে সবার প্রাপ৵ দেওয়ার পর ছেলের প্রাপ্য সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়েছেন।

আলআমিনের জন্মদাতা বাবা মারা গেছেন। এক বোন আছেন। আলআমিনকে আবার ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আলআমিন যেতে রাজি হননি। তাঁর মতে, মা হওয়ার জন্য গর্ভধারণ জরুরি বিষয় না। আর ফরিদা পারভীন বলেন, কত দিন নিজেকে শেষ করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেন, আবার এই ছেলের জন্যই সে পথ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হতেন।

ছেলে আলআমিন দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘আমার জন্য মা অনেক কষ্ট করেছেন। নিজেকে আড়াল করে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আমি চাই আমার এই মাকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে।’