বন্ধ্যত্ব: চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

বন্ধ্যত্ব বা সন্তান জন্ম দিতে পারছেন না, এ ধরনের দম্পতিরা নানা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বন্ধ্যত্ব বিষয়ে কর্মরত চিকিৎসকেরা বলছেন, বিষয়টি সরকারের নজরের বাইরেই রয়ে গেছে।

স্বামী ও স্ত্রী কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ ছাড়াই এক বছর শারীরিক সম্পর্কের পরও যদি গর্ভধারণ না করেন এবং গর্ভধারণের পর বারবার গর্ভপাত অথবা একের অধিক মৃত সন্তান প্রসব করলে তাকেও বন্ধ্যত্ব হিসেবে ধরা হয়।

দেশের কত শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের দেওয়া তথ্য বলছে, দেশের ১০ থেকে ১৪ শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছেন। যে দম্পতিদের বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় টেস্টটিউব পদ্ধতিতে সন্তান নিতে হয়, তাঁরা সরকারি পর্যায়ে কোনো সেবাই পাচ্ছেন না। টেস্টটিউব বেবি হচ্ছে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় সর্বজনস্বীকৃত একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতির একটি হচ্ছে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতি, সংক্ষেপে বলা হয় আইভিএফ। অন্যদিকে সরকারের যেসব জায়গায় আইভিএফ ছাড়া অন্যান্য সেবা পাওয়া যায়, তারও সেভাবে প্রচার নেই।

শনিবার সরকারি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের ইনফার্টিলিটি ইউনিটের সামনে মোহাম্মদপুরেরই বাসিন্দা এক নারীর সঙ্গে কথা হলো। গত চার বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসার জন্য গেলেও শনিবারই প্রথম এসেছেন এ সেন্টারটিতে। জানালেন, এ সেন্টার সম্পর্কে সম্প্রতি জানতে পেরেছেন। তবে চিকিৎসার বিভিন্ন কাগজপত্র অনুযায়ী, তাঁর টেস্টটিউব পদ্ধতি লাগবে, যা এ সেন্টার থেকে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মোহাম্মদপুরের এ সেন্টারে সন্তান না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করা ও প্রাথমিক চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, দম্পতিদের উদ্বুদ্ধকরণ ও সহায়ক সেবা, দম্পতিদের আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে পরীক্ষা করা, দম্পতিদের হরমোন প্রয়োগের মাধ্যমে ওভিউলেশন ইনডাকশনের ব্যবস্থা, বীর্যের সমস্যায় রোগীকে ইন্ট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেসানের (আইইউআই) সেবা দেওয়া হচ্ছে।

মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারেই কথা হলো প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম ও মুনিরা পারভীন দম্পতির সঙ্গে। তাঁরা বিবাহিত জীবনে ১০ বছরের মাথায় প্রথম সন্তানের মা-বাবা হয়েছেন। তিন মাস বয়সী আল-মুঈদকে কোলে নিয়ে চিকিৎসকদের মিষ্টি খাওয়াতে এসেছিলেন তিনি। জানালেন, পাবনা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তারপরই এ সেন্টারের কথা জানতে পেরেছিলেন। তবে এর আগেই চিকিৎসার পেছনে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছেন। অথচ এ সেন্টারে একদম স্বল্প খরচে স্বামী ও স্ত্রীর মোট ১৭টি টেস্ট করানো হয়। মুনিরা পারভীনকে ওজন কমানোর পরামর্শ দেওয়াসহ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে বলা হয়।

জাহাঙ্গীর আলম বললেন, ‘দেশের সব সরকারি হাসপাতালে উন্নত মানের চিকিৎসা পেলে আমাদের মতো ভুক্তভোগীদের ভোগান্তির মাত্রাটা কিছুটা কমবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দম্পতি বললেন, দেশে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় যেসব বেসরকারি সেন্টার গড়ে উঠেছে তাতে কতটুকু সেবা পাওয়া যাচ্ছে, তা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানেন। এ দম্পতি জানালেন, দুবার সন্তান গর্ভে এলেও গর্ভপাত হয়ে যায়। বিয়ের পর গত ১৬ বছরে এ দম্পতি দেশের এবং দেশের বাইরে কম করে হলেও ছয়জন চিকিৎসকের চেম্বার ও সেন্টারে গিয়েছেন। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। হতাশ হয়ে বর্তমানে কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন না।

জাহাঙ্গীর আলম ও মুনিরা পারভীন বিয়ের ১০ বছরের মাথায় বাবা–মা হয়েছেন। তবে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অনেক।  ছবি: প্রথম আলো
জাহাঙ্গীর আলম ও মুনিরা পারভীন বিয়ের ১০ বছরের মাথায় বাবা–মা হয়েছেন। তবে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অনেক। ছবি: প্রথম আলো

এ দম্পতি বললেন, মোহাম্মদপুরে এক সেন্টারে ঢুকে যন্ত্রপাতির অবস্থা দেখে চেঁচামেচি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেন্টারগুলোতে ভুক্তভোগীদের ‘ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল’ করা হয়। যেকোনোভাবে টেস্টটিউব বেবি নিতে উৎসাহিত করা হয়। আর ভুল চিকিৎসারও শিকার হতে হয়েছে এ দম্পতিকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্বামী আক্ষেপ করে বললেন,‘সন্তানের মা-বাবা হতে পারছি না, এ যন্ত্রণার সঙ্গে তিক্ততা-হয়রানি আমাদের জীবনটাকে বিষিয়ে তুলছে।’

আরেক ভুক্তভোগী দম্পতি জানালেন, গত ছয় বছরে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ধাক্কা খেতে খেতে স্ত্রীর মানসিক সমস্যা দেখা দিলে সে চিকিৎসাও করাতে হয়। টাকা খরচ, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ—সব মিলে বলতে গেলে তাঁরা সেই অর্থে সংসারই করতে পারেননি। কয়েকবার তাঁদের তালাক হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিও হয়েছে।

প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সেক্রেটারি জেনারেল সালেহা বেগম চৌধুরী বললেন, বন্ধ্যত্ব চিকিৎসাটা ব্যয়বহুল। সরকারি পর্যায়ে এ চিকিৎসা না পেলে ভুক্তভোগীদের ভোগান্তির অবসান হবে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান সালেহা বেগম চৌধুরী জানালেন, পুরোনো আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় আলাদা বিভাগ গঠনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানালেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন শেষে চিকিৎসকদের জন্য বন্ধ্যত্ব বিষয়ে বিশেষ কোর্স চালু হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালটিতে আইভিএফসহ বিশেষায়িত একটি স্থাপনা তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ স্থাপনা তৈরি হলে ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি অনেকটাই কমে যাবে।