উপেক্ষিত নারী ভাষাসংগ্রামীরা

অলংকরণ:  আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

সেদিন ছাত্রীরা নিজ দায়িত্বেই যোগ দিয়েছিলেন আমতলার সভায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাঁরা ভেঙেছিলেন ১৪৪ ধারা। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যখন সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেওয়া হলো, তখন শিক্ষার্থীদের বড় অংশটাই সেটা ভাঙার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। সে রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা তো সবাই জানে। সেখানে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষেই পড়েছিল বেশি ভোট। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পরদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার বিষয়ে প্রত্যয়দীপ্ত ছিল ছাত্রসমাজ।

আমতলার সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কি না, তা নিয়ে অল্প কিছু সময় ধরে বিতর্ক চলে। ছাত্রীরা ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে। ওই দোদুল্যমানতার সময় বিরক্ত হয়ে তাঁরা ফিরে আসেন কমনরুমে। সেখানে কিছু সময় থাকার পর ছাত্রদের অনুরোধে তাঁরা ফিরে আসেন। সে সময় ১০ জন করে মিছিলগুলো বের হচ্ছিল। আমতলা থেকে বের হওয়ার পরই পুলিশ ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।

ছাত্রীরা ভাষা আন্দোলনের সময়টাতে সক্রিয় ছিলেন। এমন নয় যে এক দিনের জন্য তাঁরা এসেছিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে।

সে সময় শাফিয়া খাতুন ছিলেন উইমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সহসভাপতি। ফলে আন্দোলন সংঘঠিত করতে তাঁর ছিল বড় ভূমিকা। সুফিয়া আহমেদ, শামসুন্নাহার আহসান, রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, মাহফিল আরা, খোরশেদী খানম, নাদিরা বেগম, হালিমা খাতুন প্রমুখেরা একুশের দিনে ছিলেন সক্রিয়।

 শাফিয়া খাতুনের স্মৃতিচারণায় দেখা যায়, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮০ থেকে ৮৫ জন। সে সময় নারীদের চলাচলের ব্যাপারেও ছিল অনেক বাধা–বিপত্তি।

২০ ফেব্রুয়ারির সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ছাত্রীদের দিক থেকে কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা হেঁটে বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ও কামরুন্নেছা গার্লস স্কুলে গিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আমতলার সভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন আমতলার সভায় যোগ দিয়েছিল স্কুলের মেয়েরা।

ভাষা আন্দোলন শুধু ঢাকা মহানগরীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নড়াইলের তিন নারী ভাষাসংগ্রামীর কথা আমরা জানি। সুফিয়া খাতুন, রিজিয়া খাতুন ও রুবি—এই নামগুলোই শোনো যায়। কিন্তু ঢাকার বাইরের নারী ভাষাসংগ্রামীদের নিয়ে এখনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

ভাষাসংগ্রামীরা হয়ে গেছেন ইতিহাসের অংশ। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের আলোচনায় বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতো নারীদের কথা একবার বলে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তাঁদের ত্যাগ ও আন্দোলনের প্রতি একাগ্রতার স্বীকৃতি তাঁরা খুব একটা পাননি। মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদক প্রাপ্তির তালিকায়ও তাঁদের হাতে গোনো কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। একুশে পদকের তালিকায় ২০০২ সালে সুফিয়া আহমেদ, ২০১৭ সালে এসে পাওয়া যাচ্ছে শরীফা খাতুনের নাম। আর ২০১৯ সালে হালিমা খাতুনকে দেখা যাচ্ছে একুশে পদক প্রাপ্তির তালিকায়। ঢাকায় আন্দোলনকারী ছাত্রীদের বাইরে নারায়ণগঞ্জের মরগ্যান স্কুলের প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম আর শহীদ মিনারের নকশাকারী নভেরা আহমেদ এই পদক পেয়েছেন। এম আর মাহবুব সম্পাদিত ভাষা সংগ্রামী মমতাজ বেগম বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কারা নির্যাতনের একপর্যায়ে সরকারের চাপে মমতাজ বেগমকে স্বামী তালাক দেন। এ বিষয়গুলোও কোনো না কোনোভাবে ইতিহাসে থাকা জরুরি।

গত বছরের ডিসেম্বরে মারা যান ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় দাফনের আগে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করার দাবি জানান স্থানীয় লোকজন। অবশ্য এ কথা বলে রাখা ভালো, ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই এখনো একুশে পদক পাননি।

ঢাকা মহানগরীতে ধানমন্ডির কয়েকটি সড়কের নাম ভাষাসংগ্রামীদের নামে করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও নারী ভাষাসংগ্রামীদের কারও নাম নেই। পাঠ্যপুস্তকে ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা অংশে ছাত্রীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারটা বিশদভাবে আসা দরকার।

গণমাধ্যমেও যখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রতিবেদন আসে, তখন আলাদা করে নারী ভাষাসৈনিকদের নিয়ে আলোচনা হয় না বা হলেও তা খুবই কম সময় নিয়ে দায়সারাভাবে করা হয়।

শবনম ফেরদৌসী তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ভাষা জয়িতা নির্মাণ করতে গিয়ে ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলের এক নারী ভাষাসৈনিককে নিদারুণ অবহেলায় মৃত্যুবরণ করতে দেখেছিলেন। তিনি বললেন, এ প্রামাণ্যচিত্রটি শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশনে একবার দেখানো ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে এর প্রচার বা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ভাষাসংগ্রামীরা একে একে চলে যাচ্ছেন। খুব কমসংখ্যক ভাষাসংগ্রামীই এখন জীবিত আছেন। আর তাঁদের যে বয়স হয়েছে, তাতে এখন ৬৮ বছর আগের কথা বলার মতো অবস্থায় আছেন খুব কম ভাষাসংগ্রামী। সামাজিক ও রাষ্ট্রিকভাবে তাঁদের মূল্যায়ন করার বিষয়টি এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও গবেষকেরা এ নিয়ে কাজ করছেন বটে, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের নথিপত্রের প্রতিই তাঁদের আগ্রহ বেশি। নির্দিষ্ট করে নারী ভাষাসংগ্রামীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কাজ করা হয়নি বললেই চলে।

আমাদের দেশে মূল্যায়নে কার্পণ্য নতুন ঘটনা নয়। তারপরও যেকোনো সচেতন মানুষের চাওয়া—ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী নারীদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হোক।