ছাত্রের হাতে বিশ্বকাপ

বাঁ থেকে আকবর আলী ও শামীম পাটোয়ারির সঙ্গে অধ্যক্ষ ইমরান ইবনে রউফ। ছবি: সংগৃহীত
বাঁ থেকে আকবর আলী ও শামীম পাটোয়ারির সঙ্গে অধ্যক্ষ ইমরান ইবনে রউফ। ছবি: সংগৃহীত

‘স্যার আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।’

প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠে ছিল বিশ্বকাপ জয়ের তাজা উচ্ছ্বাস। এর চেয়ে অনেক বেশি পিতৃতুল্য স্যারের প্রতি ভালোবাসা ও মমত্ববোধ। ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলা কথাটি ইতিহাস গড়া সেনাপতি আকবর আলীর, যাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে ভারতকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বকাপ জয়ের পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ১৮ বছরের যে বিস্ময়বালককে মাথা উঁচু করে দেখতে হচ্ছে, সেই ‘সম্রাট’ আকবর হোটেলে ফিরে মা-বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে যে মানুষটিকে ভিডিও কলে বলেছিলেন, ‘স্যার আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল’, তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) সাবেক অধ্যক্ষ কর্নেল ইমরান ইবনে রউফ।

পরিচয়ে স্পষ্টত কোচ নন, সুতরাং খেলোয়াড় তৈরির কাজটাও তাঁর নয়। আকবরদের খেলোয়াড় হিসেবে তৈরিও করেননি। তবে অধ্যক্ষ থাকাকালে মানসিকভাবে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গড়ে তুলতে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একজন অধ্যক্ষের কাজ সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার তদারকি করা। সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেই তিনি ছুটে যেতেন মাঠে, সময় দিতেন তাঁর ছাত্রদের। তাঁর সেই ছাত্রদের আটজন অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। ইমরান ইবনে রউফের কণ্ঠে গর্ব, ‘আমি ভাগ্যবান ও গর্বিত। চ্যাম্পিয়ন দলের আটজন ছেলে আমাকে “প্রিন্সিপাল স্যার” বলে সম্বোধন করে।’

প্রিন্সিপাল স্যারকে নিয়ে আকবরের মন্তব্য, ‘স্যার আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝতেন, অনুপ্রেরণা জোগাতেন। আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, রানার্স আপ হলে কেউ মনে রাখবে না। চ্যাম্পিয়নই হতে হবে।’

বিকেএসপির প্রিমিয়ার লিগে ফেরা

২০১১ সালে প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট থেকে অবনমন হওয়া বিকেএসপি পুনরায় প্রথম বিভাগে রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ারে ফেরে ২০১৮ সালে। পাঁচ মৌসুম পর দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে ফিরে আসা ছিল অবশ্যই আকবর, শামিম পাটোয়ারিদের সোনালি প্রজন্মের হাত ধরে। তবে বারবার উঠে এসেছিল ইমরান রউফের নাম। তিনি নিজে সাবেক ক্রিকেটার বলেই মাঝেমধ্যে ব্যাট-বল হাতে তুলে নিয়ে ছাত্রদের অনুপ্রেরণা জোগাতেন। অনুশীলন ম্যাচ চলাকালে দাঁড়িয়ে যেতেন আম্পায়ারের ভূমিকায়। ছেলেদের কৌশলগত জ্ঞান কখনোই দেননি, কিন্তু তাঁদের মানসিকভাবে চাঙা রাখার দায়িত্বটি খুব ভালোভাবেই পালন করেছিলেন।

আধো অন্ধকার ভোরে ঘুম থেকে উঠে দলের সঙ্গে ছুটে যেতেন ফতুল্লা–মিরপুর। ছেলেদের পানি টানা থেকে শুরু করে বুট জুতোর ফিতা বেঁধে দেওয়ার কাজও আনন্দ নিয়ে করেছেন তাঁদের ‘প্রিন্সিপাল স্যার’। দলের খেলোয়াড়দের দাবি, ‘স্যারের ৫ মিনিটের কথা আমাদের জন্য ছিল পুরো একটি ম্যাচ খেলার ব্যাটারির চার্জ।’

ইমরান রউফ ও বিকেএসপি

দুই বছরের বেশি সময় বিকেএসপির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি মাঝের কিছু সময়ে ভারপ্রাপ্ত প্রশিক্ষণ পরিচালক ও পরিচালকের (প্রশাসন ও অর্থ) দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে আজাদ বয়েজ, রূপালী ব্যাংকের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। বিকেএসপির বর্তমান দুই কোচ মন্টু দত্ত ও মতিউর রহমানের সঙ্গেও খেলেছেন তিনি।

বিকেএসপি অধ্যায় নিয়ে তাঁর খোলামেলা বক্তব্য, ‘ভাবতাম তরুণ প্রজন্ম নিয়ে যদি একটু কাজ করতে পারতাম। সৌভাগ্যক্রমে আমার সে সুযোগটা চলে আসে বিকেএসপিতে। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ের মতো না দেখলেও ছাত্রছাত্রীদের কোনো অংশে আমার ছেলেমেয়ের চেয়ে কম ভাবিনি। বিকেএসপি ছিল আমার ঘর ও পরিবার। এক-আধটু ক্রিকেট খেলার সুবাদে ছেলেদের মানসিকতা আমি বুঝতে পারতাম। ওদের যদি একটু মানসিকভাবে চাঙা রাখা যায়, তাহলে ওরা আরও ভালো কিছু করতে পারবে—এই বিশ্বাস আমার ছিল। আমি অধ্যক্ষ হলেও সবাইকে এক রকম পড়ার চাপ দিতাম না। আমি বুঝতাম, কোন ছেলে বড় ক্রিকেটার হবে, আর কে পারবে না। সুতরাং যার মধ্যে বড় ক্রিকেটার হওয়ার গুণ আছে, তাকে আমি ক্লাসে আসার জন্য চাপ দিতাম না। কিন্তু খেলা শেষ হলেও আবার কান ধরে এনে ক্লাসে বসিয়ে দিতাম।’

ছাত্রদের নিয়ে অধ্যক্ষের ৩ কথা

এটাই তো ছিল আমার স্বপ্ন...

বিকেএসপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই শুনতাম সাকিব ও মুশফিকের নাম। কিন্তু আমি যেহেতু ওদের ছাত্র হিসেবে পাইনি, তাই ওদের নিয়ে গর্ব করা আমাকে মানায় না। অতএব ভাবছিলাম, আমাকে সাকিব-মুশফিকের মতো ছাত্রদের স্যার হতে হবে। আমি অধ্যক্ষ হিসেবে খেলোয়াড় তৈরি করতে পারব না, কিন্তু ওদের মধ্যে চ্যাম্পিয়নের মানসিকতা গড়ে তোলার চেষ্টা তো করতে পারি। আকবরের হাতে বিশ্বকাপ দেখার পর আমার মন শান্তি পেয়েছে। আর ও যখন হোটেলে ফিরেই আমাকে ফোন করেছে, সে আনন্দ প্রকাশ করার মতো না। এটাই তো ছিল আমার স্বপ্ন।

আকবরকে বইয়ের পোকা বানানো...

রিকি পন্টিংয়ের আত্মজীবনী (পন্টিং: অ্যাট দ্য ক্লোজ অব প্লে), শচীন টেন্ডুলকারের একটি বই, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির রিদম অব স্পিন—এই তিনটা বই আকবরকে দিয়েছিলাম। কারণ ওর পড়ে বোঝার মতো মেধা আছে। আর দ্য আর্ট অব স্লেজিং নামের একটি বইয়ের কিছু অংশ অনুবাদ করে বেশ কিছু ছেলেকে দিয়েছিলাম। আমি মাঠে খেলা দেখতে গিয়ে দেখি, বয়সে বড় ক্রিকেটাররা আমার ছেলেদের আজেবাজে গালি দেয়। মেনে নিতে পারিনি। কারণ ওরা ফেয়ার প্লে ট্রফির জন্য পরিশ্রম করে না। পরে বইটার কিছু অংশ দিয়ে বলেছি, সামনের ম্যাচ থেকে আমি স্লেজিংয়ের জবাব দেখতে চাই। মাথা নিচু করে খেলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না।

চ্যাম্পিয়ন ছাত্রদের যেখানে দেখতে চাই...

স্বল্পমেয়াদী হিসেবে ২০২৩ বড়দের বিশ্বকাপে ওদের দেখতে চাই। আর দীর্ঘ মেয়াদের কথা বললে প্রত্যেক ছেলেকে টেস্ট খেলোয়াড় হিসেবে দেখতে চাই। আমার দেশের একজন ব্যাটসম্যান ১০ হাজার রান করবে, এটা দেখা আমার স্বপ্ন। এই দলের শামীম পাটোয়ারির সেই সামর্থ্য আছে। ব্যাট হাতে ও বিশ্ব মাতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ছেলেটাকে শুধু নিয়ন্ত্রিত মানসিকতার মানুষ হিসেবে তৈরি করতে হবে। আকবর ও মাহমুদুল হাসান সেই সামর্থ্য রাখে। ব্যাটিংয়ে আরও অনেক সময় ব্যয় করতে হবে ওদের।