ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট হাতে

স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়েই আয়োজন ছিল ক্লিয়ার মেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ
স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়েই আয়োজন ছিল ক্লিয়ার মেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপ

‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে/ আরে লাল লাল নীল নীল বাতি দেইখ্যা নয়ন জুড়াইছে...’। তাদের মনের মধ্যে হয়তো বাজছে জনপ্রিয় গানটি। তবে এই সুর মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ইংল্যান্ডে পা রাখতে যাচ্ছে দেশের ছয় কিশোর ফুটবলার। তাদের আকাশে চাঁদ পাওয়ার মতো সুযোগটি করে দিয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বড় বড় ভবন আর দোতলা বাস দেখে কাটছিল না ঘোর। তার আগেই ইংল্যান্ডগামী উড়োজাহাজে ওঠা। তা–ও আবার ইংলিশ ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের অনুশীলনের উদ্দেশে।

টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউনিলিভারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্লিয়ার মেন অনূর্ধ্ব-১৭ স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। সারা দেশের ২৭২টি স্কুল অংশগ্রহণ করে টুর্নামেন্টে। গ্রুপ পর্ব শেষে ৮ বিভাগের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলগুলো নিয়ে ঢাকায় হয়েছে চূড়ান্ত পর্ব। অক্টোবরে রোমাঞ্চকর এক ফাইনালে টাঙ্গাইলের সুতী ভিএম পাইলট স্কুলকে সাডেন ডেথে ৬-৫ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বগুড়ার পুলিশ লাইনস স্কুল।

পুরো টুর্নামেন্টের বাছাই করা সেরা ৩৫ জন নিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) অনুষ্ঠিত হয় তিন সপ্তাহের ক্যাম্প। সেখান থেকে বাছাই করে সেরা ছয় জনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট। স্কুলপড়ুয়া এই ছয়জন হলো বাগেরহাটের চিরুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের মোল্লাহ খালিদ হোসেন; নীলফামারীর ছমির উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চন্দন রয়, আল আমিন, মোরসালিন ইসলাম; বরিশালের ব্যাপ্টিস্ট মিশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মঈনুল ইসলাম এবং টাঙ্গাইলের সুতী ভিএম পাইলট স্কুলের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম।

এলাকায় সে রাজমিস্ত্রির জোগালি

বাগেরহাট জেলার সদর থানার চিরুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করছে খালিদ হোসেন। ইংল্যান্ডগামী ছয়জনের মধ্যে একমাত্র গোলরক্ষক সে। খুলনা বিভাগীয় ফাইনালে কালিয়া সরকারি পাইলট স্কুলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ঢাকার চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেয় তার স্কুল। মূল পর্বে এসে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও এই গোলরক্ষকের পারফরম্যান্স উঠে যায় কোচদের নোট বুকে। পুরো টুর্নামেন্ট থেকে বাছাই করা ৩৫ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ডাক পায় চারজন গোলরক্ষক। সবাইকে পেছনে ফেলে ইংল্যান্ডের বিমানে উঠতে যাচ্ছে খালিদ।

কোচিং স্টাফের সমন্বয়কারী আবদুর রাজ্জাক খালিদ হোসেন সম্পর্কে বলছিলেন, ‘এই বয়সেই ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতা। ভবিষ্যতে আরও লম্বা হবে। শেখার আগ্রহ প্রচুর। কখন পোস্ট ছেড়ে বের হয়ে আসতে হবে—এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ভালো।’

এই কিশোর ফুটবলারই একদিন হয়তো আলো ছড়াবে জাতীয় পর্যায়ে
এই কিশোর ফুটবলারই একদিন হয়তো আলো ছড়াবে জাতীয় পর্যায়ে

ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এই কিশোরের অভাবী পরিবারে বেড়ে ওঠা। নিজের এলাকায় খালিদের পরিচয় রাজমিস্ত্রি হিসেবে। প্রায় চার বছর ধরে রাজমিস্ত্রির জোগালি (সহকারী) হিসেবে কাজ করছে সে। রাজমিস্ত্রির কাজ করায় যে ছেলেটা এত দিন বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা বলার সাহস পায়নি, ম্যানচেস্টার সিটির টিকিট সেই সাহস এনে দিয়েছে খালিদকে, ‘আমি তো বড় ফুটবলারই হতে চাই। কিন্তু কাজও তো আমাকে করতে হয়। ফুটবলে ভালো কিছু করতে পারলে এখন থেকে শুধু ফুটবল নিয়েই থাকব। ওখানে গিয়ে তো অনেক কিছু শিখতে পারব। তা দেশে এসে কাজে লাগাতে হবে।’ নিজের স্বপ্নের কথা বলে খালিদ।

ফসলের মাঠ থেকে ফুটবল মাঠে

মেধাবীদের মধ্যেও তো মেধাবী থাকে! ছয়জনের মধ্যে নীলফামারীর চন্দন রয় তেমনই মেধাবী। দলের মধ্যে বয়সে সবার ছোট সে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পাঁড় ভক্ত ১৫ বছরের এই কিশোর। বিদেশে রোনালদোর মতো উইঙ্গারকে পছন্দ হলেও দেশের ফুটবলে তার পছন্দের খেলোয়াড় জামাল ভূঁইয়া ও মাসুক মিয়া। টুর্নামেন্টে ছমির উদ্দিন স্কুলকে তৃতীয় হতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এই মিডফিল্ডার। ক্লিয়ার মেন স্কুল ফুটবলে খেলার আগে খেলেছে পাইওনিয়ার লিগে। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় জীবিকার তাগিদে ফুটবল খেলার পাশাপাশি মাঠে কৃষিকাজও করে থাকে। ম্যানচেস্টার সিটিতে যাওয়ার সুযোগটি চন্দনের কাছে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো, ‘ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার জন্য কষ্ট করছি। ক্যাম্পে থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এবার তো আরও বড় সুযোগ পেয়েছি, যা কোনো দিন স্বপ্নেও দেখেনি। এবার ভালো ফুটবলার হতে পারব।’

তার সম্পর্কে কোচ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘১৫ বছরের একটা ছেলে যখন ১৭ বছরের ছেলেদের সঙ্গে জায়গা করে নেবে, বুঝতে হবে তার মধ্যে বাড়তি কিছু আছে। সে দলের মধ্যে অন্যতম সেরা মেধাবী। ভালো খেলতে না পারলে অনুতপ্ত হতে দেখা যায়। প্রাণ দিয়ে ফুটবলটা উপভোগ করে।’

বাংলাদেশের দানি আলভেজ হতে চায় আল আমিন

ব্রাজিলের সমর্থক হিসেবে আল আমিন স্বপ্ন দেখত ব্রাজিল যাওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, তা ভবিষ্যতের হাতেই থাক। তবে পাঁচবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নের দেশে যাওয়ার আগেই সামনে এসে গেল ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ। দলের মধ্যে সবচেয়ে ‘হাই প্রোফাইল’ খেলোয়াড় এই রাইটব্যাক। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ জয়ী দলের সদস্য। সে খেলেছে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত উয়েফার চার জাতি অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টেও।

কোচদের সঙ্গে (বাঁয়ে থেকে নিচে বসা) আল আমিন, মোরসালিন ইসলাম, চন্দন রয়, জাহিদুল ইসলাম, মঈনুল ইসলাম, মোল্লাহ খালিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
কোচদের সঙ্গে (বাঁয়ে থেকে নিচে বসা) আল আমিন, মোরসালিন ইসলাম, চন্দন রয়, জাহিদুল ইসলাম, মঈনুল ইসলাম, মোল্লাহ খালিদ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

ফুটবলের টানে দুই বছর আগে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে যশোরের শামসুল হুদা ফুটবল একাডেমিতে। দেশের ফুটবলে আলোড়ন সৃষ্টি করা বেসরকারি এই একাডেমিতেই দেখছে নিজের ভবিষ্যৎ। দেখে ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক দানি আলভেজের মতো খেলার স্বপ্ন। যেমনটি সে বলছিল, ‘আমি তো আলভেজের ভক্ত। তাঁর মতো ওভারলেপিং করে ক্রস করার চেষ্টা করি। দেশের মধ্যে বিশ্বনাথ ঘোষকেও ভালো লাগে। তাঁর ওভারলেপিংও ভালো। ম্যানচেস্টার সিটিতে কেইল ওয়াকারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলে পরামর্শ চাইব।’

তার সম্পর্কে কোচ রাজ্জাকের বক্তব্য এমন, ‘আল আমিনের ওভারল্যাপিং খুব ভালো। আমরা যখন খেলতাম, টুটুল ভাইকে দেখতাম, খুব ভালো ওভারল্যাপ করে ভালো ক্রম 
করত। ওর মধ্যে এই গুণটা দেখি। ওভারল্যাপ করে আবার সময়মতো জায়গাতেও ফিরতে পারে।’

ঘুরে দাঁড়ানোই শক্তি মোরসালিনের

একই স্কুলের বন্ধু আল আমিনের মতো মোরসালিনও হতে পারত অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। কিন্তু চোট নামক ‘খেলোয়াড়দের শত্রু’ তা হতে দেয়নি। চূড়ান্ত দলে জায়গা পেলেও নেপালের উদ্দেশে দল দেশ ছাড়ার আগের দিন চোট নিয়ে তাকে ফিরতে হয় নীলফামারীতে। তবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে বসুন্ধরা কিংসের অনূর্ধ্ব-১৮ দলে। খেলেছে প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে। দেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে মিডফিল্ডার ইমন বাবু ও মাসুক মিয়া জনির ভক্ত।

আর বিদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে ফ্রান্সের পল পগবার একনিষ্ঠ সমর্থক সে। কিন্তু তাকে এখন যেতে হচ্ছে পগবার নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে। তবে সে দলের স্প্যানিশ ডেভিড সিলভার ভক্তও এসএসসি এই পরীক্ষার্থী। কোচিং স্টাফের সমন্বয়কারী আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘মোরসালিনের মধ্যে লড়াকু মনোভাব আছে। মানসিকভাবে খুবই দৃঢ়। মাঝমাঠে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে পটু। যেকোনো দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হওয়ার মতো সামর্থ্য রাখে।’

মিডফিল্ডার মঈনুল

ছয়জনের মধ্যে সবচেয়ে হাই প্রোফাইল বলা যায় মঈনুলকে। ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। এ বছর খেলেছে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব। সবচেয়ে বড় কথা, চলতি বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত উয়েফা চার জাতি টুর্নামেন্টে ৭ গোল করে হয়েছিল সর্বোচ্চ গোলদাতা। মিডফিল্ডার হলেও প্রয়োজনে খেলতে পারে স্ট্রাইকিং পজিশনে। তবে এমন খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও ক্লিয়ার মেন টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে গিয়েছে তার স্কুলের দৌড়। তবে ব্যক্তি মঈনুলের ফুটবলশৈলীর গল্প তো সবার মুখে মুখে।

তার সম্পর্কে কোচ বলেন, ‘স্কিল দিয়ে সে দর্শকদের মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। পছন্দ করে সব সময় সামনের দিকে খেলতে। খুবই আক্রমণাত্মক মনোভাবের খেলোয়াড়। প্রয়োজনে উইং দিয়েও খেলতে পারে দুর্দান্ত।’

বরিশালের ছেলে মঈনুল ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা বেলজিয়াম মিডফিল্ডার ডি ব্রুইনের ভক্ত। সেখানে সুযোগ পেলে ব্রুইনের কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়ার ইচ্ছে আছে তার। নিজের সম্পর্কে বলছিল এভাবেই, ‘আমি তো ম্যানচেস্টার সিটির ভক্ত। ড্র ব্রুইন ও আগুয়েরো আমার প্রিয় খেলোয়াড়। সেখানে আইনের সঙ্গে দেখা হলে পরামর্শ চাইব, মিডফিল্ডার হিসেবে কীভাবে উন্নতি করা যায়।’

দল হারলেও জয়ী জাহিদুল

রোমাঞ্চকর এক ফাইনালে টাঙ্গাইলের সুতী ভিএম পাইলট স্কুলকে সাডেন ডেথে ৬-৫ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বগুড়ার পুলিশ লাইনস স্কুল। ইংল্যান্ডগামী ছয়জনের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন দলের কোনো সদস্য নেই। রানার্সআপ দলের একমাত্র সদস্য জাহিদুল ইসলাম। টাঙ্গাইল ফুটবল একাডেমিতে ফুটবলার হিসেবে তার গড়ে ওঠা। ক্লিয়ার মেন টুর্নামেন্ট খেলার আগে খেলেছে পাইওনিয়ার লিগে। খেলেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কাপ ফুটবলে। তার প্রিয় খেলোয়াড় ব্রাজিলিয়ান গ্যাব্রিয়েল জেসুস। আনন্দের বিষয় হলো, জেসুসেসর ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতেই যাওয়া হচ্ছে তার।

জাহিদুল ইসলাম সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘জাহিদুলের কোস খুবই ভালো। উইং থেকে একেবারে মাখনের মতো ক্রস করে জায়গায় ফেলতে পারে।’