ফ্রিল্যান্সিং করতে করতে উদ্যোক্তা হয়েছি

রিফায়েতের প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করেন ২৫ জন কর্মী
রিফায়েতের প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করেন ২৫ জন কর্মী

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পরপর দুবার অকৃতকার্য হওয়ার পর রিফায়েত ইসলামের মনের অবস্থা কী হয়েছিল, একবার ভাবুন! লোকের কত কথা যে শুনতে হয়েছে। যাঁরা কিছুই বলেননি, তাঁদের চাহনিতেও যেন অবজ্ঞার ছায়া দেখতে পেতেন রিফায়েত। সেই তিনিই কিন্তু এখন দ্য সফট কিং লিমিটেড নামে একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁর অধীনে কাজ করেন ২৫ জন কর্মী। রিফায়েত অকপটে বলেন, ‘দুবার পরীক্ষায় ফেল না করলে হয়তো এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না। এখন হয়তো চাকরির জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতাম।’

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন রিফায়েত ইসলাম। ইন্টারনেটের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ২০০৬ সালে, মাধ্যমিক পরীক্ষার পর। তখন ফলাফলের জন্য তিন মাস অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। কীভাবে এই অলস সময়টা কাজে লাগাবেন, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন মনে মনে। তখন হাতে থাকা মোবাইল ফোন দিয়ে রিফায়েত যুক্ত হয়ে যান ওয়ানাওয়াপ নামের একটি মোবাইল চ্যাটিং সাইটে। মাথায় চিন্তার পোকাটা নড়েচড়ে ওঠে, ভাবতে থাকেন কীভাবে বানানো যায় এই রকম একটা ওয়েবসাইট। বিভিন্ন ওপেন সোর্সের সফটওয়্যার ব্যবহার করে বানিয়ে ফেলেন নিজের জন্য একটি চ্যাটিং সাইট। রিফায়েত যখন এই সাইট প্রকাশ করলেন, তখন অনেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। কীভাবে বানিয়েছেন? কোন দিক থেকে শুরু করেছেন? কী কী লাগে এমন সাইট বানাতে?—নানা দিক থেকে নানাজন প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। সবার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে রিফায়েতের মধ্যে তৈরি হয় আত্মবিশ্বাস।

কাজের শুরু
তিন মাসে রিফায়েত তৈরি করেন ১০টি মোবাইল ওয়াপ সাইট এবং আয় করেন ১৭ হাজার টাকা। তার মধ্যে ১২ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে রিফায়েত কেনেন একটি সেলোরন কম্পিউটার। সেই কম্পিউটার নিয়েই শুরু হয় রিফায়েতের পথচলা।

দিন-রাত কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতে থাকতে কখন যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এসেছে, তত দিনে টেরও পাননি। পরপর দুবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। একসময় তাঁকে নিয়ে এলাকার মানুষ ও প্রতিবেশীরা নানা ধরনের উপহাস করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে রিফায়েত চলে আসেন ঢাকায়। আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। নতুনভাবে মনোনিবেশ করেন পড়াশোনায়। তৃতীয়বারের চেষ্টায় পেরিয়ে যান উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি।

রিফায়েত ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
রিফায়েত ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত


শিক্ষাজীবন ও পরিবার
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক করেছেন রিফায়েত। একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়াশোনার পুরো খরচ নিজেকে বহন করতে হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে তিনি। তাঁর বাবা মারা যান ২০১১ সালে। বর্তমানে মা, স্ত্রী সাবরিনা আক্তার ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে রিফায়েতের ছোট সংসার।

এনভাটো মার্কেটপ্লেস ও আপওয়ার্ক
এনভাটো একটি মার্কেটপ্লেস, যার প্রধান অফিস অস্ট্রেলিয়ায়। এনভাটো বিশ্বের বড় ওয়েব টেমপ্লেট, ওয়ার্ডপ্রেস থিম, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মার্কেটপ্লেসগুলোর একটি। এনভাটো মার্কেটে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও এইচটিএমএল টেমপ্লেট নিয়ে কাজ করেন রিফায়েত। এ ছাড়া শুরু করেছেন নিজের মার্কেটপ্লেসে। কাজ করছেন মোবাইল অ্যাপস নিয়েও। এখন পর্যন্ত এনভাটোতে অনুমোদিত আইটেম আছে ৪৬৫টির বেশি, যা বিক্রি হয় পৃথিবীর প্রায় ৭০টি দেশে।

বর্তমান ও অর্জন
বর্তমানে তিনি দ্য সফট কিং লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে কিনে রাখা ডোমেইনটিকে রিফায়েত ২০১৫ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। রিফায়েত ইসলাম নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে সবাইকে টিমমেট বলা হয়, কেউ স্টাফ বা কর্মচারী নন। এখানে কোনো সিনিয়র-জুনিয়র নেই। সবাই দলের সদস্য হিসেবে সব বিষয়ে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত ও মতামত দিয়ে থাকেন। একা কোনো সিদ্ধান্ত আমরা নিই না। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শুধু দেশীয় প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির জন্য কাজ করতাম। ২০১৫ সালে বুঝতে পারি, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করা লাভজনক। ১০ মিনিটে সিদ্ধান্ত নিই, কাজ করব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য। এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’