বাবার ৫ উপহার: শাহরুখ খান

শাহরুখ খান।
শাহরুখ খান।

বলিউড অভিনেতা শাহরুখ খান বক্তৃতা দিয়েছিলেন ভারতের মুম্বাইয়ের ধীরুভাই আম্বানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মাধ্যমিক পেরোনো শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে। সেখানে শাহরুখ কথা বলেছেন তাঁর বাবা তাজ মোহাম্মাদ খানকে নিয়ে। বাবার কাছ থেকে পাওয়া পাঁচটি উপহারের কথা বলেছেন শাহরুখ। উপহারগুলো বলিউডের এই মহাতারকার সাফল্যের পেছনে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, দিয়েছে শিক্ষা। শাহরুখের সেই বক্তৃতার কিছু অংশ থাকছে আজ।

আজ আমি আমার বাবাকে নিয়ে কিছু কথা বলব। তিনি ছিলেন খুব বিনয়ী। আইন বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছিলেন। সাতটা ভাষা জানতেন। বিশ্বের নানা দেশে ঘুরেছেন। রাজনীতি বুঝতেন, নিজ দেশ ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন। হকি, সাঁতার, পোলোর মতো খেলায় পারদর্শিতা ছিল তাঁর। রান্না করতে জানতেন। আবৃত্তি করতেন। আর পৃথিবীর যেকোনো দেশের রাজধানীর নাম জিজ্ঞেস করলে মুহূর্তেই বলতে পারতেন।

আমার বাবা একজন দরিদ্র মানুষও ছিলেন। লম্বা সময় বেকারত্বে ভুগেছেন। জীবনের ১৫ বছর পর্যন্ত দেখেছি, তিনি আমাদের চাহিদা পূরণের জন্য কতটা সংগ্রাম করেছেন। ১০ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা আমার জন্য কোনো ঝকমারি উপহার কিনতে পারেননি। সেই সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি তাঁর নিজের খুব কাছের কোনো পুরোনো জিনিস পত্রিকায় মুড়িয়ে আমাকে জন্মদিনে উপহার হিসেবে দিতেন। তাঁর সেই জিনিস তখন থেকে আমার হয়ে যেত। আমি আজ বাবার কাছ থেকে পাওয়া সেই পাঁচ উপহার নিয়ে কথা বলব। সেই সঙ্গে বলব, কী করে এই উপহারগুলো আমাকে আজকের ‘আমি’ বানিয়েছে, আমাকে নিয়ে এসেছে আজকের এই অবস্থানে।

১. দাবা সেট
আমার বয়স যখন ১০। বাবা আমাকে একটা দাবার সেট উপহার দেন। অনেকেই বলে, দাবা হলো জীবনের প্রতিচ্ছবি। এটা খুব পুরোনো শোনালেও কথাটা সত্য। প্রথমেই এটা যা শেখায় তা হলো আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপেরই আছে কোনো না কোনো পরিণতি, আমরা এটা মানি বা না মানি। জীবনেও এমন কোনো পদক্ষেপ নেই, এমন কোনো মুহূর্ত নেই, যা অর্থহীন; কিংবা যার কোনো পরিণতি নেই। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের কোনো না কোনো পরিস্থিতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। শূন্য মুহূর্ত বা অর্থহীন পদক্ষেপ বলে জীবনে কিছু নেই। তাই প্রতিটি মুহূর্তকেই জীবনের অংশ করে নাও। দেখবে জীবনটা আদতে আর দাবার ঘরের মতো সাদাকালো লাগবে না, মনে হবে না তুমি দাবার চারকোনা ঘরে বন্দী হয়ে আছ। তোমার চারপাশ অনেক বিস্তৃত হয়ে যাবে। কোনো কোনো সময় এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কয়েক ধাপ পেছাতে হতে পারে। অল্প সময়ের জন্য এই পিছিয়ে পড়ায় কোনো ক্ষতি নেই; বরং এই পিছিয়ে পড়াই তোমার জন্য সাফল্য নিয়ে আসতে পারে।

হয়তো রানি দেখতে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, কিন্তু দাবার ঘরে তাকে বাঁচাতে গিয়ে আমাকে যদি মন্ত্রী খোয়াতে হয়, তাহলে তখন পুরো রাজ্য নিয়ে আমাকে দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতে হবে। তাই রানির মোহ কাটিয়ে কোনো কোনো সময় আমাদের কিস্তি কিংবা ঘোড়া সওয়ারের জন্য লড়াই করতে হয়। দাবায় যদি আমরা ছোট ছোট দিকগুলোর দিকে নজর না দিই, একটা সৈন্যের চালও যে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, তা না মানি, তাহলে কিন্তু খেলায় এগোতে পারব না। জীবনের বেলায়ও তা–ই। আমরা যদি জীবনের ছোট ছোট দিকগুলোকে গুরুত্ব না দিই, ক্ষুদ্র অর্জনগুলোর মূল্যায়ন না করি, আমরা কখনোই জীবনের বড় সাফল্যের দিকে যেতে পারব না। আমরা এগোতেই পারব না।

সুযোগ পেলেই আমাদের নিজেদের চারপাশ মন দিয়ে দেখতে হবে। নজর দিতে হবে ছোট ছোট দিকগুলোয়, যার কারণে আমাদের অস্তিত্ব এতটা মসৃণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের জীবনে পাওয়া সুযোগ-সুবিধাকে আশীর্বাদ না ভেবে, তাকে তুচ্ছজ্ঞান করা হলো সবচেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ।

২. টাইপরাইটার
আমার ছেলেবেলায় কম্পিউটার মোটেই প্রচলিত ছিল না, ছিল না আইফোনও। তাই তখনকার সময়ে পাওয়া আমার সবচেয়ে দামি উপহারটি ছিল বাবার ইতালীয় টাইপরাইটার। আমি তাঁর কাছ থেকেই এই টাইপরাইটার চালানো শিখেছি। শিখেছি কীভাবে তাতে টাইপ করতে হয়। কী করে রোলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাতে কাগজ দিতে হয়, লিভারটা চাপতে হয়। আঙুল দিয়ে টাইপরাইটারের বোতাম চাপার খটখট শব্দ শোনায়, সাদা কাগজে লেখা দিয়ে ভরিয়ে ফেলায় আমি এক অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছিলাম।

টাইপরাইটার সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য অধ্যবসায় খুব জরুরি। একটা ভুল অক্ষরে চাপ দিলেই আবার শুরু থেকে সব শুরু করা লাগে। এ ক্ষেত্রে ভুল শুধরানোর জন্য ‘টাইপ এক্স’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু একটা লেখায় ভুল কাটানোর জন্য অতিরিক্ত ‘টাইপ এক্স’ও আবার ব্যবহার করা যেত না। তাই আমাদের মন দিয়ে শিখতে হয়েছে, কী করে খুব ভেবেচিন্তে নিখুঁতভাবে টাইপরাইটারে হাত ঘোরাতে হয়, নিজের ভাবনাকে কাগজে তুলে আনতে হয়। আর নির্ভুল থাকার জন্য বারবার এই চর্চা করেই যেতে হয়। আমি যত বড় হয়েছি, ততই বুঝতে পেরেছি নিজেকে নির্ভুল করার চর্চা আর অধ্যবসায়ের সঙ্গে পরিশ্রম করে যাওয়ার মানসিকতার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।

৩. ক্যামেরা
আমার বাবা আমাকে একটা ক্যামেরা দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল অকেজো। ক্যামেরার সবচেয়ে দারুণ বিশেষত্ব ছিল এটাই। এ থেকে আমি শিখেছিলাম, জীবনে কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সবকিছুই সব সময় সক্রিয় হবে না। মাঝেমধ্যে ভাঙাচোরা জিনিসের চিড় থেকেও সৃষ্টিশীলতার আলো ছড়াতে পারে। আমি ওই ভাঙা ক্যামেরার নিষ্ক্রিয় লেন্স দিয়ে নিজের একটা জাদুর জগৎ দেখতে শুরু করলাম। কোনো ছবি সেই ক্যামেরা দিয়ে আমি তুলতে পারিনি, কিন্তু আমি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা পেয়েছিলাম সেই অকেজো উপহার থেকে। সেই শিক্ষা হলো—সৃষ্টিশীলতার প্রক্রিয়া শুরু হয় আত্মা থেকে। এই প্রক্রিয়া কোনো ফলাফলের প্রত্যাশা ছাড়াই শুরু হয়। পৃথিবী এই সৃষ্টিশীলতা গ্রহণ করবে, আত্মা এমনটা চায়ও না। আমাদের সত্তা শুধু চায় সৃষ্টিশীলতার সত্যিকারের বহিঃপ্রকাশ। এই বহিঃপ্রকাশ একদম ভেতর থেকে আসে। এর সঙ্গে মেকি কোনো কিছু যায় না। যেভাবে তুমি চাইবে, তোমার পৃথিবীতে তোমার সৃষ্টিগুলো ঠিক তেমনই দেখাবে। তাই নিজের মেধা ও সৃষ্টিশীলতাকে নিয়ে দ্বিধায় থেকো না, বরং একে সম্মান করো। তোমার সৃষ্টি সব সময় পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারবে, গ্রহণ করবে, এমন প্রত্যাশা কোরো না। কোনো সৃষ্টি সবার বোধগম্য হবে, এমনটা নয়। সব শিল্পই যে বিক্রয়যোগ্য হবে, তা-ও নয়। কিছু সৃষ্টি, কিছু শিল্পের মহত্ত্ব জাগতিক হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে। কিছু সৃষ্টি শুধু নিজের জন্য তুলে রাখতে হয়। যখন আমরা একা থাকি, তখন তারা আমাদের সঙ্গ দেয়। আমি যেমন কবিতা লিখি। খুব বাজে লিখি আমি। মাঝেমধ্যে একা একা সেগুলো পড়তেও বিব্রত লাগে, কিন্তু এরপরও আমি লিখি। কারণ, লিখে যে আনন্দ আমি পাই, সেই আনন্দ শুধুই আমার একার। এই আনন্দ আমাকে স্বাধীনতার স্বাদ দেয়।

শাহরুখ খান।
শাহরুখ খান।


৪. রসবোধ
আমার বাবা ছিলেন মজার মানুষ। যেকোনো গম্ভীর পরিস্থিতিকে রসিকতা দিয়ে স্বাভাবিক করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। রসবোধ ছাড়া পৃথিবী একটা নীরস আর লোভী মানুষের রাজ্য হয়ে উঠত। বাবার রসবোধের ঘটনা বলি।

আমরা সে সময় একটা ভবনের তিনতলায় থাকতাম। আমি আর আমার বন্ধু বারান্দা থেকে অনেক আজেবাজে জিনিস দুষ্টুমি করে নিচতলার বারান্দায় ফেলতাম। নিচতলায় থাকা বুড়ো লোকটা একদিন বিরক্ত হয়ে গেলেন। নিচ থেকে চিৎকার করে বলতে থাকলেন, ‘ভাই ভাই, ওপর থেকে জিনিস নিচে পড়ছে। ওপর থেকে জিনিস নিচে পড়ছে।’ আমি তো ভয়েই শেষ। বাবা বারান্দায় এসে ঠান্ডা মাথায় অবস্থা দেখে বললেন, ‘চাচা, ওপর থেকে যে জিনিস নিচে পড়ে, এটা নিউটন অনেক বছর আগেই আবিষ্কার করেছেন। আপনি যদি নতুন কিছু বলতে চান, তাহলে বাসায় চলে আসুন। চা খেতে খেতে কথা বলি।’ সঙ্গে সঙ্গেই পুরো পরিস্থিতি একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল।

এ থেকে আমি শিখেছিলাম, সুযোগ পেলে নিজেকে নিয়েও হাসতে দ্বিধা কোরো না। যদি একবার নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ও সহজভাবে নিতে শিখে নেওয়া যায়, তাহলে কোনো হতাশা, কোনো অবসাদ, ব্যর্থতা আমাদের ভাঙতে পারবে না। রসবোধ হলো পৃথিবীর বাস্তবতাকে দেখার স্বচ্ছ কাচ। এটা হলো টিকে থাকার রক্ষাকবচ। তরুণ আর শিশুসুলভ থাকার আমৃত্যু টিকিট হলো রসবোধ।

৫. জীবন
আমার বাবা আমাকে সবচেয়ে সুন্দর আর সর্বশেষ যে উপহার দিয়েছেন, সেটার মর্ম আমি বুঝেছি যেদিন তিনি মারা গেলেন। আমার বয়স তখন ১৫। উপহারটা প্রত্যেক মা–বাবা তাঁদের সন্তানদের দিয়েছেন। উপহারটি হলো ‘জীবন’। এই উপহারের সৌন্দর্যকে আর কোনো উপহার, কোনো আশীর্বাদই স্পর্শ করতে পারে না। জীবনের সৌন্দর্য অন্য সব সৌন্দর্যকে ছাড়িয়ে যায়। তাই জীবনের প্রতি সব সময় আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তাঁদের প্রতি, যাঁরা এই জীবন আমাদের দিয়েছেন, অর্থাৎ মা–বাবার প্রতি। জীবনের লাবণ্যকে আমরা উপলব্ধি করতে পারলে আর এই উপলব্ধি সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে পারলে তুমি তোমার স্বপ্নের চেয়েও বড় হতে পারবে। তাই জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ হও, মা–বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।

ভুল করো, ভুল থেকে শেখো, মুক্ত হও, সাহসী হও, জীবনকে উপভোগ করো। তাহলেই তুমি সফল হবে। আর যখন তুমি একজন সফল মানুষ হয়ে উঠবে, তখন তোমার সবচেয়ে অপছন্দের শিক্ষককে মনে করে একটা ধন্যবাদ দিয়ো। কারণ, আদতে সেই শিক্ষকই তোমাকে গড়ে তুলেছেন, তোমাকে নিয়ে ভেবেছেন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান