একুশের আঁকিয়েরা

শিক্ষার্থীরা আলপনা আঁকেন দল বেঁধে। ছবি: হাসান রাজা
শিক্ষার্থীরা আলপনা আঁকেন দল বেঁধে। ছবি: হাসান রাজা
>

প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনার এলাকাটি রঙিন হয় চেতনার সাজে। দেয়ালে দেয়ালে বাংলা বর্ণ, রাস্তায় আঁকা ছবি, শহীদ মিনারের বেদিতে আঁকা আলপনা আমাদের এই দিনটির তাৎপর্য মনে করিয়ে দেয়। আড়ালে থেকে যাঁরা এই সাজসজ্জার পুরো দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। আজকের মূল রচনা তাঁদের নিয়ে।

একুশে ফেব্রুয়ারির বেশ কদিন আগে থেকেই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণের পরিবেশ বদলে যায়। আশপাশ দিয়ে হেঁটে গেলে টের পাওয়া যায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি। তবে এত কিছুর মধ্যেও একদল উচ্ছল তরুণের সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে যাবে। কেউ দেয়ালচিত্র আঁকায় মগ্ন, কেউ আঁকেন আলপনা, ঝাড়ু হাতে শহীদ মিনার এলাকাটা ঝাঁট দেন কেউ কেউ। আশপাশের কোনো কিছুতেই তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। একমনে তাঁরা নিজের কাজ করেন।

মূলত প্রতিবারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় বিভিন্ন আঙ্গিকে শহীদ মিনার ও তার আশপাশটাকে সাজিয়ে তোলার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয় চারুকলা অনুষদ। ঠিক কবে থেকে তাঁরা এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন, সেটা ঠিকঠাক কেউ বলতে না পারলেও ধারণা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারির আগে শহীদ মিনার সাজানোর কাজ করেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। দিন দিন এই সাজসজ্জা ও অলংকরণের পরিধি বেড়েছে।

রং-তুলির দিন
চারুকলা অনুষদের ৮টি বিভাগের প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী প্রতিবছর রাঙিয়ে তোলেন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। শুধু শহীদ মিনারই নয়, আশপাশের দেয়ালে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম, বিশাল তোরণ ও রাস্তায় আলপনা আঁকার কাজটাও তাঁরাই করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির দুই-তিন দিন আগে শুরু হয় কাজ। ক্লাস শেষে দল বেঁধে চলে আসেন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। তারপর? শুরু হয় রং-তুলির খেলা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিন নেই রাত নেই...শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গেলেই আমার নাকে লাগবে রং, তারপিনের গন্ধ।

১৮ ফেব্রুয়ারির কথা। কাজ করতে করতেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নিদ্রা দে বলেন, ‘ছোটবেলায় এখানে যখন ঘুরতে আসতাম, তখন থেকেই শখ ছিল একদিন আমিও এখানে আঁকব। প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি দুই মাসও হয়নি। তবু আমাদের যে এত বিশাল একটা দায়িত্বের অংশ হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এটাই একটা বড় পাওয়া।’

একুশে ফেব্রুয়ারির আগে শহীদ মিনারের আশপাশের দেয়ালগুলোই হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের ক্যানভাস। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
একুশে ফেব্রুয়ারির আগে শহীদ মিনারের আশপাশের দেয়ালগুলোই হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের ক্যানভাস। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

আঁকাআঁকির কারণেই শহীদ মিনার এলাকা পরিণত হয় চারুকলা অনুষদের সিনিয়র-জুনিয়রদের এক বিরাট মিলনমেলায়। শিক্ষকেরাও হাত লাগান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তিন বছর ধরে সব আয়োজনে ভিন্ন এক মাত্রা এনেছে দেয়াল চিত্রাঙ্কন। আগের চেয়ে এখন দেয়াল চিত্রাঙ্কন নিয়েও থাকে নিত্যনতুন পরিকল্পনা। ‘বিখ্যাত কার্টুনিস্ট, আমাদের শিশির ভট্টাচার্য স্যার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজে উপস্থিত থেকে সব কটি দেয়াল চিত্রাঙ্কনের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। এমনকি তিনি নিজেও আমাদের সঙ্গে আঁকেন। রাত-দিন শিক্ষকেরা আমাদের পাশে থাকেন ’ বলছিলেন ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী তন্ময় দেবনাথ।

শিল্পের সঙ্গে শৃঙ্খলা
হাসি-আড্ডা, ঠাট্টা-তামাশার সঙ্গে কাজটাও যে সমানতালে চলতে থাকে, তা অবশ্য আর বলে দিতে হয় না। একেকজনের নিপুণ হাতে আঁকা হতে থাকে একেকটি আলপনা। নিমেষেই অন্য আরেকজনের তুলির ছোঁয়ায় সেখানে বসে যায় নানা রং কিংবা নকশা। এভাবে লাল ইটের বেদি, ইটের দেয়াল কিংবা পিচঢালা রাস্তা—সবই হয়ে ওঠে শিল্পীর ক্যানভাস।

প্রিন্টমেকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজির হোসেন খান বলেন, ‘শিক্ষক হলেও আমরা তো আসলে শিল্পী। প্রতিবছরই মহামান্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে আপামর জনতা এখানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে আসেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াতেই লেগেছে শৃঙ্খলার ছোঁয়া, যেটা আগে এতটা ছিল না।’ নাজির হোসেন খান আরও জানান, শহীদ দিবস এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপীই একসঙ্গে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারির শোক আজ পরিণত হয়েছে বিশাল এক শক্তিতে। তাই সবারই উচিত সুশৃঙ্খলভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা।

আঁকিবুঁকি তিন দিন আগে শুরু হলেও এর পরিকল্পনা অবশ্য মাসখানেক আগে থেকেই নেওয়া হয়। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের নেতৃত্বে শুরু হয় পরিকল্পনা। তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনারে শহীদ দিবস (আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস) পালন শুরু হয়েছে ১৯৭২ সালে। এর আগেই অবশ্য বামপন্থী নেতারা এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শুরুর দিকে শিল্পীরা শহীদ মিনারে আঁকতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শুরু হওয়ার দু–এক বছরের মধ্যেই সম্ভবত চারুকলা অনুষদ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদ মিনার সাজানোর দায়িত্বটা পায়। সেটা ১৯৮০–এর দশকের শুরুর দিকের কথা। তবে আমি মনে করি, কীভাবে শুরু হয়েছিল, সেটা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন উপলক্ষে মোট ১৩টি কমিটি কাজ করে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সব ধরনের সহায়তা দেয়। তবে সাধারণের চোখে যা ধরা পড়ে, পুরোটাই চারুকলার শিক্ষার্থীদের পরিশ্রমের ফসল।

শহীদ মিনার সাজাতে একসঙ্গে কাজ করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার
শহীদ মিনার সাজাতে একসঙ্গে কাজ করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ছবি: খালেদ সরকার

প্রথমে মূল বেদির কাজ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় রাস্তায় আলপনা আঁকা। দোয়েল চত্বর থেকে শুরু করে পলাশী পর্যন্ত আলপনা আঁকা হয়। সেই সঙ্গে চলতে থাকে তোরণ নির্মাণের কাজ। তোরণে কিংবা রাস্তায় আঁকা বর্ণগুলো এতটাই নিপুণ হাতে আঁকা হয় যে হঠাৎ দেখায় মনে হয় বুঝি ছাপার অক্ষর। এর পেছনের মূল কারিগর যে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা, তা অবশ্য সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলেন। টাইপোগ্রাফির কল্যাণে মুহূর্তেই বাংলা অক্ষরগুলো অপরূপ হয়ে ওঠে।

গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জারিন সালসাবিল বলেন, ‘প্রথম বর্ষে যখন জানতে পারলাম আমরাই এই কাজগুলো করতে পারব, তখনই খুব ভালো লাগছিল। কারণ, টিভিতেই তো সব সময় দেখি আমরা। নিজে হাতে আঁকার অনুভূতি অন্য রকম। প্রথম প্রথম কাজ করতে গিয়ে নানা ভুল করেছি। সে জন্য বকাও খেয়েছি। একবার তো আলপনার ভেতরে বর্ডার না রেখে সম্পূর্ণটাই রং করে ফেলেছিলাম। পরে বকা খেয়ে নিজেই তারপিন তেল দিয়ে ঘষে ঘষে সম্পূর্ণ রং তুলে আবার করেছি। আবার যিনি বকা দিয়েছিলেন, তিনিও পরে আমাকে আইসক্রিম খাইয়েছিলেন।’

সুন্দরের জন্য
তবে কাজটা শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, আসলে মোটেও তা নয়। রোদের মধ্যে পিচঢালা রাস্তা এমনিতেই গরম হয়ে থাকে, সেখানে একটানা বসে কাজ করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। তবু দেশের মানুষকে সুন্দর কিছু উপহার দেওয়ার প্রত্যয়ে সেটুকু কষ্ট সয়ে নেন এই শিক্ষার্থীরা। কারণ, দিন শেষে মানুষের হাসিটাই তাঁদের মূল পারিশ্রমিক।

এখানে কাজ করতে গিয়ে মন খারাপ হলেও আসলে সেই অনুভূতি বেশিক্ষণ থাকে না। মন খারাপ হলেও রং–তুলির বুননে সুন্দর একটা আলপনা আঁকতে আঁকতে এমনিই মন ভালো হয়ে যায়। সবারই প্রচেষ্টা থাকে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার। যাতে প্রতিবছরের মতো শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা প্রত্যেক মানুষের মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বের হয়, ‘বাহ! কী সুন্দর!’