সৌন্দর্যের আড়ালের জীবন

বাগানের সবুজ বুকে নারী শ্রমিকদের চা–পাতা তোলার ছবির সৌন্দর্যের আড়ালে নারীদের জীবনটা তেমন আনন্দময় নয়।  ছবি: আকমল হোসেন
বাগানের সবুজ বুকে নারী শ্রমিকদের চা–পাতা তোলার ছবির সৌন্দর্যের আড়ালে নারীদের জীবনটা তেমন আনন্দময় নয়। ছবি: আকমল হোসেন

রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে নারী চা-শ্রমিকের জীবনের ৩০ থেকে ৩৫টি বছর দাঁড়িয়ে চা-বাগানের টিলায় টিলায় পাতা তুলেই নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই চা-বাগানের সবুজ বুকে পাতা তোলার ছবি যতটা চোখকে মুগ্ধ করে, এই নারীদের জীবনের গল্প ততটা আনন্দদায়ক নয়।

দেশে চা–শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকের অর্ধেকের বেশি নারী। পাতা বা কুঁড়ি তোলার প্রধান কাজটিই করেন নারী চা-শ্রমিকেরা। এর বাইরে নার্সারিতে চারা কলমের কাজ করেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারী শ্রমিকেরা এই কাজ করে গেলেও কাজের ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তার অনেক কিছুই এখনো নাগালে আসেনি। এই নারীরা অর্থ উপার্জন করলেও এখনো পরিবারে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাঁরা পিছিয়ে। কিছু বাগানমালিক নারী শ্রমিকদের জন্য কিছু উদ্যোগ নিলেও তা অত্যন্ত অপ্রতুল।

 সারা দেশে ১৬৭টি চা-বাগান আছে। দেশের চা-বাগানগুলোয় প্রায় এক লাখ চা-শ্রমিক কাজ করছেন। এই শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। এই শ্রমিকদের আছে আলাদা জীবনধারা, ভাষা-সংস্কৃতি।

মৌলভীবাজার জেলাতেই আছে ৯২টি চা–বাগান। জেলার বিভিন্ন চা–বাগানের একাধিক নারী শ্রমিক জানান, সেই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়। সংসারের কাজ করতে হয়। বাগান দূরে হলে আগেভাগে রওনা দিতে হয়। সপ্তাহে সোম থেকে শনিবার পর্যন্ত সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। কেউ সকাল খেয়ে বের হন, কারও সময় না থাকলে বাটিতে খাবার নিয়েই ছুটতে হয়। দুপুরে খাবার বলতে চাল ভাজা, চায়ের কুঁড়ি পাতা, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ ইত্যাদি দিয়ে বানানো ‘পাতিচখা’ বা ‘পাতি চাটনি’। লাইনে (শ্রমিকদের বসতি) ফিরতে ফিরতে কারও সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা বেজে যায়। ঘরে ফিরে আবার সংসারের কাজ।

কাজের স্থানে নারী শ্রমিকদের জন্য কোনো শৌচাগার নেই। বাধ্য হয়েই নারীরা খোলা জায়গা ব্যবহার করেন বা প্রস্রাব-পায়খানা দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। পিরিয়ড বা মাসিকের সময় অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করেন বা অনেকে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর উপায় অবলম্বন করেন।

 চা-বাগানে বর্তমানে দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা। এ মজুরি পেতে বাগানভেদে ২০ থেকে ২৫ কেজি চা–পাতা তুলতে হয় নারী শ্রমিককে। বাড়তি চা-পাতা তুললে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা, তাও পান না বেশির ভাগ নারী শ্রমিক। চা-পাতা তোলার স্থানে গাড়ি থাকার কথা। কিন্তু অনেক বাগানেই গাড়ি থাকে না। অনেক নারী চা-শ্রমিককে কাজের স্থান থেকে উত্তোলিত পাতা ওজন করে জমা দেওয়ার জন্য পাতার গাট্টি পিঠে করে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে যেতে হয়। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে এ কাজ করতে হয়। বৃষ্টির সময় রেইনকোট দেওয়ার কথা। কিন্তু তা দেওয়া হয় না বেশির ভাগকেই। সেকশনে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকার কথা, তাও থাকে না।

রাজনগর উপজেলার করিমপুর চা-বাগানের নারী শ্রমিক কাজল রায় আলাপকালে বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য বাগানে তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। অন্তঃসত্ত্বা নারী চা-বাগানে নিয়মিত পাতা তোলার কাজই করেন। বাগানে হালকা-পাতলা কাজ থাকলেও তাঁদের হালকা কাজের সুযোগ দেওয়া হয় না।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক নারী ফোরামের আহ্বায়ক এবং চা-শ্রমিক মহাসংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক গীতা রানী কানু বলেন, এত বড় চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখছেন নারীরা। তা সত্ত্বেও চা-বাগানের নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত। চা-শিল্পের অগ্রগতি ঘটাতে হলে নারী চা-শ্রমিকের প্রতি সুদৃষ্টি দিতে হবে। তাঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। নারী শ্রমিকদের হয়রানি ও তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।

কাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন নারী শ্রমিকেরা।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরছেন নারী শ্রমিকেরা।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বললেন, চা-বাগানে অর্ধেক নারী শ্রমিক হলেও নারী হিসেবে কর্মস্থলে যে সুযোগ-সুবিধা থাকার দরকার, তা তাঁরা পাচ্ছেন না। কর্মক্ষেত্রে শৌচাগার নেই। এটার দাবি আছে। চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নিরিখের অতিরিক্ত চা–পাতার প্রকৃত মজুরি থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে এখনো অনেকে তেমন কিছু জানেন না। চা-বাগানে সরকারি সুবিধা অনেকটা পৌঁছেছে। আরও পৌঁছানো দরকার। তিনি আরও বলেন, চা-বাগানে নারীরা উপার্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা পিছিয়ে। কিছু কিছু অগ্রগতি হলেও পরিবারে পুরুষেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। নারীর চিন্তাভাবনা কাজে লাগছে না। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের পঞ্চায়েত ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ নারীর ক্ষমতায়ন শতভাগ থাকলেও এখনো অনেক ঘাটতি আছে।

তবে চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা-সংসদের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী বলেন, শ্রমিকেরা মজুরি ১০২ টাকা পান। (শ্রমিকদের) ইউনিয়ন আছে। ইউনিয়নের সঙ্গে দুই বছর পরপর মালিকপক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সবকিছু ঠিক করা হয়। চা-বাগানে সব শ্রমিক বিনা মূল্যে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। বাড়ির খোলা জাগায় সবজি চাষ, এমনকি ধানও চাষ করেন অনেকে। বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। হাসপাতাল আছে। একজন শ্রমিক দুই টাকা কেজি দরে চাল পান। পরিবারের তিনজন সদস্য পর্যন্ত এ সুবিধা পান। সবকিছু হিসাব করলে একজন শ্রমিক দৈনিক ক্যাশসহ ৩৫০ টাকা পান। অন্য যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকের চেয়ে এই শ্রমিকেরা ভালো আছেন।

নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম এক বছর ধরে হবিগঞ্জ, সিলেটসহ তিনটি চা–বাগানের নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছে। এ ফোরামের আহ্বায়ক মার্জিয়া প্রভা বললেন, চা–বাগানগুলোয় ভায়া টেস্ট করে দেখা গেছে, অনেক নারী শ্রমিক জরায়ুমুখের ক্যানসারের ঝুঁকিতে আছেন। নারীদের জরায়ুমুখ নেমে যাওয়াও একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাগানগুলোয়। এই নারীদের স্বাস্থ্যসচেতন করতেও তেমন উদ্যোগ নেই।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চা–শ্রমিকদের ওপর কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক ফিলিপ গাইন বলেন, দেশের চা–বাগানগুলোয় কাজ করা শ্রমিকেরা একধরনের আবদ্ধ জীবন যাপন করেন। চা–শ্রমিকেরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। সেই ব্রিটিশ আমলে চা–বাগানের কাজের জন্য এই শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়েছিল বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সেই থেকেই বঞ্চনার শুরু। মানুষের বিকাশের যত সুযোগ, তার সবকিছু থেকেই
তাঁরা বঞ্চিত।