মানুষ হিসেবে ভালো হলে সব সহজ: মুশফিকুর

>
মুশফিকুর রহিম। ছবি: শামসুল হক
মুশফিকুর রহিম। ছবি: শামসুল হক
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে দুর্দান্ত এক ডবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান এখন তাঁর দখলে। ২০১৮ সালে শিশু–কিশোরদের মাসিক পত্রিকা কিশোর আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজের পড়ালেখা, শৈশব, কিশোর-তরুণদের জন্য পরামর্শসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। আজ সেটিরই সংক্ষিপ্ত রূপ থাকল স্বপ্ন নিয়ের পাঠকদের জন্য।

ছেলেবেলা

ছোটবেলায় কখনো ভাবিনি যে এটা হব বা ওটা হব না। খেলাধুলা করার ইচ্ছা ছিল প্রবল। পড়াশোনা খুব একটা ভালো লাগত না। তবে খেলোয়াড় হব—এ রকম ইচ্ছাও ছিল না। ছোটবেলা থেকে পাড়ায় ক্রিকেট খেলি। তখন শুধু ইচ্ছা ছিল যে খেলাধুলা করব, পাশাপাশি পড়াশোনা করব। তারপর কী হবে, সেটা পরের ব্যাপার।

স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আমার খেলাধুলার শুরু। ক্লাসের সময় ছিল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা। বাসায় এসেই হোমওয়ার্ক করতে হতো। একজন গৃহশিক্ষক আসতেন। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যেত, তিনি এসে বসে আছেন, কিন্তু আমি নেই। খেলতে গেছি বিকেলে। বিকেলে পড়াশোনা করব, এটা কখনো ভাবিনি। তাই অধিকাংশ সময় দেখা যেত যে স্যার এসে ঘুরে যেতেন এবং আমার বাসা থেকে বলা হতো যে ‘ও তো নাই, খেলতে গেছে।’ তিনিও বলতেন, ‘আজ থাক, কালকে পড়াব।’ এভাবে অনেক সময়ই পড়তে যেতাম না। তবে পড়াশোনা করতে হবে—এ রকম চাপে ছিলাম না কখনো। খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম।

মুশফিকুর রহিম। ছবি: শামসুল হক
মুশফিকুর রহিম। ছবি: শামসুল হক

তখন ফেব্রুয়ারিতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলত। ওই সময় অনেক খেলাধুলা হতো। আমিও নাম দিতাম খেলায়। খেলার নাম করে আমি ওই এক মাস যে কোথায় থাকতাম, নিজেও জানতাম না। খেলার জন্য ব্যাগে সব সময়ই এক জোড়া জুতা আলাদা থাকত। যেন সময় পেলেই আমি খেলতে পারি। আমাদের খেলার শিক্ষক হজরত আলী স্যারও জানতেন যে আমি খেলাধুলার পেছনেই একটু বেশি সময় কাটাই। স্যারও সুযোগ পেলে আমাকে খেলার দিকেই নিয়ে যেতেন বেশি।

বিকেএসপির দিনগুলো
সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই বিকেএসপিতে। ভর্তি হওয়াটাও একটা অন্য রকম প্রতিযোগিতা। আমার এখনো মনে আছে, আমি ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাই আমার ছোট চাচার সঙ্গে। সেদিন হরতাল ছিল। বিকেএসপির ভর্তি পরীক্ষা হবে কি না, এ নিয়ে একটা সন্দেহ ছিল। পরে সন্ধ্যায় জানতে পারি যে পরের দিনই পরীক্ষা হবে। ফলে ওই রাতেই যেতে হবে। আমরা একটু দ্বিধায় ছিলাম। রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে গিয়ে পৌঁছাই। রুমে কোনো জায়গা নেই। কারণ, অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলে এসেছে অন্যরা। বারান্দাতেই ছিলাম আমরা। পরদিন ভর্তি পরীক্ষায় খুব চিন্তিত ছিলাম। কারণ, আমরা যখন ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছি, তখন ত্রিশ-চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী এসেছিল ভর্তি পরীক্ষার জন্য। ওখান থেকেই শুরু আমার যাত্রা। আর বিকেএসপির জীবনটা একটু অন্য রকম ছিল। নিয়মানুবর্তিতা বা সময় মেনে কাজ করাটা ওখান থেকেই শুরু হয়। তারপর আমার যে বন্ধুরা ছিল, তারা মিলে সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনুশীলনে যাওয়া বা ওখান থেকে স্কুলে যাওয়া কিংবা নিজে এসে নিজের কাপড় ধোয়া আর রুম পরিষ্কার করা। আবার দুপুরে সবাই লাইন ধরে ডাইনিং হলে যাওয়া, খাওয়া—সবকিছু ক্যাডেট স্কুলের মতো।

বাসা ছেড়ে দূরে থাকতে খুব কষ্ট হতো। কারণ, আমি যৌথ পরিবার থেকে এসেছিলাম। এ রকম একটা হোস্টেলে একা একা থাকা অনেক কষ্টকর ছিল আমার জন্য। অনেক কান্নাকাটি করতাম। আমার রুমমেট ছিলেন সোহরাওয়ার্দী শুভ। তিনিও পরে জাতীয় দলে খেলেছেন। আমি তাঁকে ধরে কাঁদতাম। তিনি আমাকে ধরে কাঁদতেন। তখন মোবাইল নিতে দিত না। তাই আমরা চিঠি লিখতাম। আমার বাসা থেকে চিঠি এলে ওটা ডাইনিং হলে জানানো হতো যে আমার চিঠি এসেছে। চিঠি পড়তে পড়তে দেখা যেত চিঠিই ভিজে গেছে চোখের পানিতে। এ রকম অনেক কষ্টই ছিল সে সময়টায়। তারপরও উপভোগ করতাম। আমাদের যাঁরা বড় ভাই, তখন নাঈম ইসলাম বা নাজমুল ভাই ছিলেন, তাঁরা সবাই অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলতেন। তখন দেখতাম যে এখানে যদি ভালো খেলি, আমারও ভালো কিছু করার সুযোগ আছে। এটা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিত। একটু একটু করে এগোতে এগোতে শিখেছি অনেক কিছু।

যে কারণে ইতিহাসের ছাত্র

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়েছি। অধিকাংশ বিষয়ে দেখা যেত অনেক সময়ই সেশনজট থাকে বা সমস্যা থাকে ওই ডিপার্টমেন্টের মধ্যে। একটু কঠিন হয় কোর্সটা শেষ করা। ইতিহাসে কয়েকজন বড় ভাই ছিলেন, যেমন সালাউদ্দিন স্যার, তিনিও ওখানে থেকে পড়তেন। শুভ্র ভাই আছেন, আরও আছেন সানোয়ার ভাই, যাঁরা জাতীয় দলে খেলেছেন। তাঁদের থেকেও শুনেছি যে ইতিহাসের বিভাগটা একটু সহজ। ওখানের স্যার-ম্যাম যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেক সাপোর্টিভ। যেহেতু আমি মানবিক বিভাগে পড়েছি, তো আমি সহজে পারব। আমার ইচ্ছা ছিল অর্থনীতি বা অন্য কিছু নিয়ে পড়ার। তবে এগুলো পড়লে অনেক সময় ক্লাস করতে হবে। মিস করলে সমস্যা হয়। এগুলো একটু কঠিন। ইতিহাসটা একটু সহজ যে আমি নোট পেলেও পড়তে পারি এবং একা একা পড়া যায়। আর ওখানে মুখস্থ করার বিষয়। শুধু পড়ে লিখতে হয়। এদিক থেকে একটাই কারণ। আমি অনেক ভাগ্যবান যে স্যাররা বা বন্ধুরা সহযোগী হিসেবে ছিলেন, যাঁরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আল্লাহর রহমতে কোনো সেশনজট হয়নি। এবং আমি খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে পেরেছি।

পড়ার সঙ্গে খেলা

পড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় অনেক সমস্যারই মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষায় আমি সময় পেয়েছি খুব কম। বিকেএসপিতে ছিলাম ছয় বছর। তার চার বছরই কেটেছে বাইরে। কারণ, আমি অনূর্ধ্ব-১৫ দল থেকে খেলা শুরু করি। তারপর ক্রমান্বয়ে অনূর্ধ্ব-১৭, ১৯ ও হাই পারফরম্যান্স, তারপর একাডেমি থেকে অনেক জায়গাতেই খেলতে হয়েছে আমাকে। পড়াশোনার জন্য খুব কম সময় পেয়েছি। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে ১৫ থেকে ২০ দিন পড়েছি। উচ্চমাধ্যমিকেও একই অবস্থা। তবে আমার বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি মানবিক বিভাগে থাকার ফলে তাদের দেওয়া নোটগুলো পড়েই ভালো করতে পারতাম। যখন বাইরে যেতাম, চেষ্টা করতাম ওই বই এবং নোটগুলো নিয়ে যেতে। অবসর পেলেই পড়ার চেষ্টা করতাম। এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

প্রসঙ্গ মা-বাবা

আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো—আমাকে নিয়ে মা-বাবা অনেক গর্ব বোধ করেন। আমি তাঁদের সেই গর্ববোধের জায়গায় রাখতে চাই সব সময়। এটা একটা বড় অর্জন আমার জন্য। তাঁরা যখন মাঠে আসেন, তখন চেষ্টা থাকে যেন ওই সময়টা ভালো কিছু করি। যেন তাঁরা ওই রকমই খুশি থাকেন। আরেক দিক দিয়ে এটা অনেক আনন্দের বিষয় যে আমার বাবা শুধু আমার জন্য চিন্তা করেন না, আমি আউট হলেও তিনি দল জিতলে অনেক খুশি থাকেন। এ রকম মা-বাবা পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।

কিশোর-তরুণদের জন্য পরামর্শ

সবকিছুর আগে একজন ভালো মানুষ হওয়া জরুরি। সেটা হতে পারলে সবকিছু খুব সহজ হয়ে যায়। আর যারা ক্রিকেটার হতে চায়, তাদের জন্য বলব—ক্রিকেট একটা সাধনার বিষয়। মানুষ ক্রিকেটার হোক, কিংবা পাইলট, প্রকৌশলী—যা-ই হোক, সবকিছুতেই সাধনার প্রয়োজন। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। নিয়মশৃঙ্খলা মানতে হয়। এই কাজগুলো করলে শুধু ক্রিকেটার নয়, মানুষ যা চায়, সেটাই হতে পারবে। এটা ঠিক যে সমাজ থেকে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেটা আসলেই একটু কম। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কিন্তু গত তিন-চার বছরে আমাদের মেয়েরা মাশাআল্লাহ ভালো খেলছে। আমার মনে হয় যে অভিভাবকেরা এ ক্ষেত্রে সেই সুযোগটা করে দিচ্ছেন তাদের। এখন অনেক ছেলেমেয়ে ক্রিকেট খেলছে এবং তাদের সেই সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হয়, সুযোগটা তাদের দেওয়া উচিত। কারণ, কার কোন জায়গায় কোন প্রতিভা আছে, এটা কেউ বলতে পারে না। জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে অন্তত তাকে সুযোগটা দেওয়া উচিত। যদি না হয়, তাহলে আলাদা কথা, কিন্তু সুযোগটা তো দেওয়া যায়।