সুযোগ বেড়েছে, বাধা কাটেনি

সূত্র: শ্রমশক্তি জরিপ, বিবিএস
সূত্র: শ্রমশক্তি জরিপ, বিবিএস

অসুস্থ বাবার জন্য ফলমূল আর অন্যান্য জিনিস কিনতে প্রায়ই স্বামীর কাছে টাকা চাইতে অস্বস্তি হতো নারগিস আহমেদের। তখন থেকেই ভাবতেন, নিজে আয়-রোজগার করবেন। তারপর মাত্র ৩০টি পোশাক নিয়ে ফেসবুকে পাতা খুলে ব্যবসা শুরু করেন।

নারগিস এখন একটি বুটিক ও একটি বাসনপত্রের দোকানের মালিক। নিজের টাকা আর স্বামীর টাকা মিলিয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন। এখন সংসারের খরচ, ফ্ল্যাটের মাসিক কিস্তি ও দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ তিনিই চালাচ্ছেন।

নারীরা আজকাল পোশাক, প্রসাধনী, নিত্যপণ্যের দোকান বা খাবারের ব্যবসা যেমন করছেন, তেমনি কেউ কেউ সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, হালকা প্রকৌশলী যন্ত্রপাতি বা আসবাব নির্মাণ অথবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মতো উদ্যোগ গড়ে তুলছেন। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগের কল্যাণে ঘরে বসে ব্যবসা ও সংসার—দুটোই দেখভালের সুযোগ হওয়ায় নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক নারীর কর্মসংস্থানও হচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ  বললেন, নারী উদ্যোক্তারা পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। তবে তাঁদের এগোনোর পথে অনেক বাধা আছে। নারীরা অনেক সময় প্রস্তুতি ছাড়া ব্যবসায় নামছেন।

 বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের শেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী দেশে তখন ৭৮ লাখের মতো ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান ছিল। এর মাত্র ৭ শতাংশের মালিক নারী। তাঁদের বড় অংশ ব্যবসা পরিচালনা করতেন।

চট্টগ্রামে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিএস অ্যাপারেলসে পণ্য দেখছেন বেবি হাসান।  ছবি: সৌরভ দাশ
চট্টগ্রামে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিএস অ্যাপারেলসে পণ্য দেখছেন বেবি হাসান। ছবি: সৌরভ দাশ

বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) বলছে, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি আয়মূলক কাজ করেন। তাঁদের মাত্র ১২ শতাংশ উদ্যোক্তা।

আর্থিক লেনদেনবিষয়ক বহুজাতিক কোম্পানি মাস্টারকার্ড ৫৮টি দেশের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের মধ্যে একটি জরিপ করে থাকে। গত বছরের জরিপটি বলছে, বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি নারী।

গৃহিণী আর ছাত্রীরা

সিলেটের তরুণী লুবানা ইয়াসমিনের বিয়ে হয়েছিল এসএসসি পাসের আগেই। বছর না ঘুরতে মেয়ের মা হন। কয়েক বছর পর স্নাতক পাস করেন। এখন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান আছে, সিলেট শহরে তিনটি সরকারি প্রকল্পের কাজ করছেন।

২০১৭ সালে সরকারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশন ১ হাজার ৫১০ জন নারী উদ্যোক্তার মধ্যে একটি জরিপ করে। গত বছর প্রকাশিত ফল বলছে, এসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগের বয়স ৩১ থেকে ৫০-এর মধ্যে। তাঁদের ৬৭ শতাংশ আগে গৃহিণী ছিলেন।

জরিপটি বলছে, গৃহিণীদের পরই নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বড় অংশ ছাত্রী।

১৯৮৪ সালে ৩০০ টাকা বেতনে একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছিলেন খুলনার সাকেরা বেগম। পরে তিনি কাপড়ে ব্লক, বাটিক ও সুই-সুতার কাজ করে বিক্রি করতেন।

সাকেরার এখন পাটজাত পণ্যের একটি কারখানা ও একটি দোকান আছে। একটি নারী কল্যাণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জয়িতা ফাউন্ডেশন নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। উৎপাদিত পণ্য বিপণনের ব্যবস্থা করে। ফাউন্ডেশনের তালিকাভুক্ত ৮৮টি সংগঠনের নারী উদ্যোক্তারা এ সুবিধা পান।

অনলাইনের কল্যাণে

তাসলিমা মিজি নিজের নকশায় নিজের কারখানায় চামড়ার পণ্য তৈরি করে অনলাইন দোকানের মাধ্যমে সেগুলো দেশে-বিদেশে বিক্রি করেন। তিনি বললেন, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন যে কেউ মুঠোফোনের সাহায্যে যেকোনো পণ্যের দেশি-বিদেশি বাজারের হদিস জানতে পারে। নারীদের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগানো।

ইন্টারনেট, ই-কমার্স আর ফেসবুকের প্রসারের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তা বাড়ার একটা সম্পর্ক আছে। পোশাক, প্রসাধনী, খাবার থেকে ঘরের সরঞ্জাম—অনলাইন পরিসরে নারীরা কী না বিক্রি করছেন!

ফেসবুকে বিকিকিনির প্ল্যাটফর্ম ‘শপআপ’ পণ্যের তালিকা সাজানো, হিসাব-নিকাশ করা, ঋণ পাওয়াসহ নানা বিষয়ে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করে। সেখানে দুই লাখের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৎপর। তাঁদের অর্ধেক নারী।

মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন বাংলাদেশে ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের সমিতিটির সহসভাপতি। তিনি বললেন, এখন প্রায় ৪০ হাজার ফেসবুক পাতার মাধ্যমে অনলাইনে বেচাকেনা চলছে। বছরে ২০ হাজার কোটি টাকারও ব্যবসা হচ্ছে। সেখানে অনেক নারী উদ্যোক্তা আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা ইশরাতুল জাহান এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার করে  নিজের ঘরে বিয়ের কনে সাজানোর কাজ শুরু করেন, সম্প্রতি পারলার খুলেছেন। তাঁর প্রচারণার শুরু ফেসবুকে।

বাধা এখনো বিস্তর

মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বললেন, সরকার নারীদের অর্থনৈতিক সমতাকে গুরুত্ব দেয়। এক বছরের মধ্যে এক লাখ নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে চায়। এ জন্য মন্ত্রণালয় আরও সুযোগ বাড়াতে যাচ্ছে।

কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের পারিবারিক ও সামাজিক বাধা এখনো আছে। পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় তাঁদের চ্যালেঞ্জ বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফের মতে, এখনো পুঁজিই নারী উদ্যোক্তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। ব্যবসার শুরুতে পরিবার থেকে মূলধন দিতে চায় না, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতেও ট্রেড লাইসেন্সসহ নানা কাগজপত্র লাগে। জামিনদার লাগে।

ট্রেড লাইসেন্সের শর্তগুলো সব নারী পূরণ করতে পারেন না, বিশেষত শিক্ষার্থীরা। জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ অনুযায়ী এসএমই খাতে ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। তবে তা সব সময় হয় না।

আন্তর্জাতিক এনজিও এশিয়া ফাউন্ডেশনের গত বছরের একটি সমীক্ষা বলছে, সে বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালে বাংলাদেশ ব্যাংক ৮০ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ দিয়েছে। এর মাত্র ৭ শতাংশের মতো পেয়েছে নারী উদ্যোক্তা। অথচ উদ্যোগগুলোর ২২ শতাংশেরই মালিক নারী।

শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আপত্তির কারণে শুধু স্বামীকে জানিয়ে নিজের শোবার ঘরে লুকিয়ে রূপসজ্জার কাজ শুরু করেছিলেন স্বর্ণলতা রায়।  এখন সিলেট শহরে তাঁর দুটি পারলার ও আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভাগীয় উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তিনি।

স্বর্ণলতা ২০০৪ সালে ব্যাংকে আবেদন করে ঋণ পাননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসার শুরুতে পরিবার টাকা দেয় না। দরকারের সময় ব্যাংকও ফিরিয়ে দেয়। সিলেট জেলায় নারী

প্রথম আলো যতজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছে, তাঁরা সবাই সরকারের কাছে সহজে ব্যাংকঋণ পাওয়ার সুযোগ চেয়েছেন। তাঁরা লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে বলেছেন। তাঁরা প্রশিক্ষণ ও পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রেও সহায়তা চেয়েছেন।

খুলনা জেলার প্রবীণ উদ্যোক্তা সাকেরার মতে, এসবের পাশাপাশি সমাজের মনোভাব বদলানোর নানামুখী তৎপরতা দরকার।