আবার দাঁড়িয়েছি ঘুরে

>
দুর্ঘটনায় একদিন স্বাভাবিক জীবনযাপন হারিয়েছিলেন তাঁরা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে আবারও ঘুরে দঁাড়িয়েছেন তাঁরা—(ঘড়ির কাঁটার দিকে) বাহার উদ্দিন, মারজানা আক্তার, মো. ইউনুস ও মিনার উদ্দিন। ছবি: ছুটির দিেন ও সংগৃহীত
দুর্ঘটনায় একদিন স্বাভাবিক জীবনযাপন হারিয়েছিলেন তাঁরা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে আবারও ঘুরে দঁাড়িয়েছেন তাঁরা—(ঘড়ির কাঁটার দিকে) বাহার উদ্দিন, মারজানা আক্তার, মো. ইউনুস ও মিনার উদ্দিন। ছবি: ছুটির দিেন ও সংগৃহীত
আগামীকাল ১৫ মার্চ বিশ্ব পঙ্গু দিবস। সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে দেশে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন। এমনই দুর্ঘটনায় হাত–পা হারিয়ে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন হয়েছে যাঁদের, তবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অসীম মনোবল নিয়ে, তাঁরা লিখেছেন নিজেদের জীবনের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা, বর্তমানের কথা।
মারজানা আক্তার। ছবি: ছুটির দিনে
মারজানা আক্তার। ছবি: ছুটির দিনে

হুইলচেয়ার চালিয়ে তবু খেলছি
মারজানা আক্তার ,অধিনায়ক, নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দল, সাভার

ছোটবেলা থেকে আমি ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। সারা দিন খেলাধুলা নিয়ে পড়ে থাকতাম। তবে বড় হতে হতে কিছুটা যেন গুটিয়ে নিলাম। সেই জীবনেই ঘটল দুর্ঘটনাটি। জীবনের সব এলোমেলো হয়ে গেল আকস্মিক এক দুর্ঘটনায়।

২০১৫ সালের ৬ জুন। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য পরদিন ঢাকায় আসব। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের বাড়িতে তারই প্রস্তুতি চলছিল। সকাল শুরু হয়েছিল ছোট বোনকে তৈরি করে স্কুলে পাঠিয়ে। দুপুর তখন সাড়ে ১২টা। আমাদের বাড়ির সামনে ছোট জামগাছ ছিল। দুই দিন ধরে বিদ্যুৎহীন গ্রামে একটু শীতল বাতাসের জন্য গাছে উঠেছিলাম। গাছে বসে ছোট বোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আপু আর আম্মা গাছে দেখে তাগাদা দিচ্ছিলেন নামার জন্য। কিন্তু আমি কেন শুনব তাঁদের কথা!

বিরক্ত হয়ে আম্মা একসময় চলে গেলেন। আপুও একটু দূরে যাওয়ার সময় জামগাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলাম। মাটিতে পড়ে মনে হয়েছিল আমি একটা ডাবলিং বল। একবার ওপরে উঠছি আবার নিচে পড়ছি। এর পরের ৫ মিনিট কিছুই জানি না।

যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি আমি আমার ঘরে। চারপাশে মানুষ। অনেকে ধরাধরি করে অটোরিকশায় করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানালেন, পিঠের পেশি ছিঁড়েছে। দ্রুত ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। ঢাকার আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলো। দুই দিন পর চিকিৎসক জানালেন, মেরুরজ্জুতে আঘাত পেয়েছি, মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করতে হবে। দুর্ঘটনার ১২ দিন পর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হলো। সেই দুঃসহ সময়গুলো মনে পড়লে এখনো শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

অস্ত্রোপচারের পর থেরাপির জন্য সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) ভর্তি হতে হলো। ভর্তি হওয়ার ১০ দিন পর এক্স-রে রিপোর্ট দেখে জানানো হলো আমার প্রথম অস্ত্রোপচারে ভুল ছিল। আগের হাসপাতালেই দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের জন্য নেওয়া হলো। তারপর আবার সিআরপিতে থেরাপির জন্য ফিরে আসা।

সিআরপিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল একা থাকা। কারণ, আমি বাবাকে ছাড়া কোনো দিন কোথাও থাকিনি। থেরাপি নেওয়ার সময়ই জানতে পারি, আমি আর আগের মতো চলাফেরা করতে পারব না। কৈশোরে এই সত্য মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া আমার জন্য কষ্টের ছিল। এই চ্যালেঞ্জকে জয় করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে আবার পরিবার ও আমার সিআরপি পরিবার। তাই সিআরপিতে থেরাপি নেওয়ার সময়টা আমার কাছে পুনর্জন্মের মতো মনে হতে থাকল। থেরাপি নেওয়ার সময় এক ঘণ্টা করে খেলার সময় পেতাম। আমি হুইলচেয়ারে বাস্কেটবল খেলতে মাঠে যেতাম। খেলার তেমন কিছুই জানতাম না, কিন্তু দলে ভিড়েছিলাম।

তিন মাস পর থেরাপি নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু পাড়া–প্রতিবেশীর কথা, সমালোচনা আমার বাড়ির পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছিল। এর মধ্যে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সিআরপি থেকে বাস্কেটবল দলে খেলার জন্য ডাক পড়ল। আমি এক মাসের ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করলাম। প্রথম সিআরপিতে নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দল গঠন করা হলো। আমি দলে কনিষ্ঠ সদস্য। এক নতুন জীবনের শুরু হলো।

সেই নতুন জীবনে পড়াশোনাও চালিয়ে নিতে থাকলাম। ঢাকায় শেরেবাংলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কলেজে যাওয়া, ক্লাস করা, বাসায় আসাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে আমার কলেজজীবন কাটতে থাকল। বাস্কেটবল খেলাও চলতে থাকল। বিভিন্ন ক্যাম্পে আমি অংশগ্রহণ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে ২০১৭ সালের নেপালে টুর্নামেন্ট উপলক্ষে সিলেকশন ক্যাম্পে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পাই। আমার বড় পাওয়া ছিল এটি। সে বছর নেপালে গিয়েছিলাম। প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। সেই সঙ্গে আমার ছোটবেলার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন পূরণ হলো প্রথম প্লেনে উঠে।

সেই স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। এখন আমি সিআরপিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের অধীনে বিএসসি ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংঙ্গুয়েজ থেরাপি বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। যেখানে রোগী ছিলাম সেখানে আমি এখন শিক্ষার্থী। নিজেকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করাতে চাই, আমাকে দেখে যেন অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হন। অবহেলিত, প্রতিবন্ধীসহ সব নারীর দৃষ্টান্ত হতে চাই।

বাহার উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত
বাহার উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

আমিই আমার অনুপ্রেরণা
বাহার উদ্দিন, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের জহিরপাড়ায় পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন টানা হয়েছিল সবে। কারও বাড়িতে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়নি। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের জহিরপাড়া, আমাদের ছায়া–সুনিবিড় গ্রাম।

গ্রামের স্কুলে আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। ২০০৪ সালের কথা সেটা। দিনটিও মনে আছে, ৩০ অক্টোবর। বিকেল সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে। বাড়ির পাশে খেলছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসানো ট্রান্সফরমারে একটি ছোট পাখি ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও দেখি পাখিটা বেরোচ্ছে না। আমার ছোট মনে প্রশ্ন জাগে, ঘটনা কী? পাখিটা কি আটকা পড়ে গেল? পাখির অবস্থা দেখার জন্য খুঁটি বেয়ে ওপরে উঠি। ট্রান্সফরমারের কাছে চলে আসি। ট্রান্সফরমারের কাছাকাছি এসে তারে হাত দিয়ে ফেলি। হাত দিতেই বিকট শব্দে ছিটকে পড়ি নিচে।

জানি না এরপর কী হয়েছে। পরে শুনেছি। প্রতিবেশীরা উদ্ধার করেন। ঝলসে যায় আমার দুই হাত, বুকের কিছু অংশ ও পায়ের তালু। নেওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসা চলে। পাঁচ দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হয় আমার এক হাত। এরপর কাটা পড়ে আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। ১৬ দিন পর জ্ঞান ফিরে পাই। মনে পড়তে থাকে সেদিনের ঘটনা। তখনই দেখি আমার হাত দুটো নেই। পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো।

চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ভারতের মাদ্রাজ নিয়ে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু অর্থের অভাবে সম্ভব হয়নি। মা ছাড়া আমার কেউ নেই। তিনিই বুকে আগলে রাখলেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকলাম। বাড়ি ফিরলাম আরও ছয় মাস পর।

হাসপাতাল থেকে ফিরে কিছুদিন ঘরে কাটিয়েছি। কিন্তু এভাবে কত দিন। পড়াশোনা করার তাগিদ অনুভব করি। একদিন খালাতো বোনের উৎসাহে পায়ে ও মুখে লিখতে শুরু করি। প্রথমে কিছুতেই পারছিলাম না। কয়েক দিন যেতেই অক্ষর লেখাটা আয়ত্তে আসে। সেই দিনটি আমার ভীষণ আনন্দের ছিল। মনে মনে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম, আমি আবার লিখতে পারছি।

লেখা শিখতে শুরু করার দুই মাস পর ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে গ্রামের আল রায়েদ কমপ্লেক্স নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই। শিক্ষক ও আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে আবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে পড়া শুরু করি। এরপর ২০০৮ সালে ভর্তি হই চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। আমার পড়ার আগ্রহ দেখে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক নুরুল কবির চৌধুরী বইপত্র কিনে দেন। ২০১৪ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করি। এরপর ব্যবসায় শিক্ষা পরিবর্তন করে মানবিক বিভাগ নিয়ে ভর্তি হই চকরিয়া কলেজে। বরাবরের মতো এগিয়ে আসেন আত্মীয়স্বজন। কলেজের শিক্ষকেরা সাহস জোগান। কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম গিয়াস উদ্দিন আমার বেতন মওকুফ করেন।

২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষার সময় স্যাররা আমাকে শ্রুতলেখক নিতে বোর্ডে আবেদনের পরামর্শ দেন। আমি বলেছি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা নিজে লিখে পাস করেছি। এইচএসসিতেও নিজে লিখব। পরীক্ষা শেষে দেখলাম, স্যারদের কথাই সঠিক হলো। খুব কম নম্বর নিয়ে পাস করি। তবে নিজের তৃপ্তি লাগে, নিজের খাতায় নিজে লিখেছি। তা ছাড়া আমি বাড়তি ১৫ মিনিটও নিইনি।

এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়ি। ওই সময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি চাকরির খুব প্রয়োজন অনুভব করি। মা খেতে–খামারে কাজ করতেন, এখন তিনি অসুস্থ, এভাবে কত দিন। কিন্তু কাজ পাই না। নিজের জমানো ও পরীক্ষার সময় পাওয়া টাকা একত্র করে একটি কম্পিউটার কিনে ফেলি। বাড়িতে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলি। দেখলাম, আয় মন্দ হয় না। দুজনের সংসার চলে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি আবেদনের সময় চলে আসে। আয়ের টাকায় খেয়ে–পরে সংসার চললেও ভর্তির আবেদনের জন্য টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। এগিয়ে এলেন এক আত্মীয়। ২ হাজার ৫০০ টাকা দিলেন আবেদন করার জন্য। সেই টাকায় ভর্তি ফরম নিলাম। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেলাম ইতিহাস বিভাগে ভর্তির।

এখন আমি স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছি। সেই উদ্যোগ থেকেই প্রতিষ্ঠা করেছি ‘খাবার লাগবেই’ নামে অ্যাপভিত্তিক সেবা। চট্টগ্রাম শহরে এর মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করা হয়। আমার সঙ্গে কয়েকজন কাজের সুযোগ পেয়েছে। পাশাপাশি ‘কেমনে যাব ডটকম’ নামে অপ্রচলিত স্থানে যাতায়াতের জন্য পরিবহন তথ্যসেবার একটি ওয়েবসাইটও আমি চালাই। মনের টানে যুক্ত আছি বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে। আর দশটা মানুষের মতোই নিজেকে আমি ভাবি। আমি আমার দারিদ্র্য বা অঙ্গহানির জন্য নিজেকে সংকুচিত করে রাখিনি, চেষ্টা করেছি নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা হতে।  

মিনার উদ্দিন। ছবি: খালেদ সরকার
মিনার উদ্দিন। ছবি: খালেদ সরকার

তবু ইচ্ছাগুলো উঁকি দেয়
মিনার উদ্দিন 
পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো

 ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্টে পুড়েছে শরীর, পুড়বে স্বপ্নও?’ প্রশ্নবোধক শিরোনামের এই সংবাদ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে যখন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়, তত দিনে আমার স্বপ্নগুলো অনিশ্চয়তার আগুনে দগ্ধ। পোড়া শরীর আর পোড়া স্বপ্ন নিয়ে কেবলই যেন বেঁচে থাকা। হাসপাতালের সফেদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেলে আসা হুলুস্থুল দিনগুলো ভাবতে গিয়ে অসহায় লাগত খুব। অতীত আর অনাগত জীবনের মাঝখানে আমি যেন এক সুদীর্ঘ হাহাকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বোনা ক্যাম্পাস, স্যার এ এফ রহমান হলের দুরন্ত জীবন, মার্কেটিং বিভাগের স্পোর্টিং টিম—সব মিলিয়ে দারুণ এক ছন্দময় জীবন আমার। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তবিভাগ ফুটবল ও ক্রিকেটে আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম। আগাগোড়া স্পোর্টসম্যান আমি। সে বছর বেশ ভালোও খেললাম। ফুটবল–অন্তঃপ্রাণ দুটো পা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ দাপিয়ে বেড়াল সে বছর। অথচ আজ সেই আমি দুটো কৃত্রিম পায়ে জীবনের ভার বয়ে চলছি।

সেই ভয়াবহ মুহূর্তটা স্মৃতির পাতায় চিরস্থায়ীভাবে যেন ছাপ মেরে বসে আছে। ৩৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা শেষ করে ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি বেড়াতে। ২০১৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। রাত ১১টা। বাড়ির পাশের একতলা দোকানের ছাদে ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দোকানটির ভবন–সংলগ্ন বৈদ্যুতিক খুঁটির একটি অনাবৃত ১১ হাজার ভোল্ট পরিবাহী তারের সঙ্গে ডান হাত লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শরীরে আগুন লেগে যায়। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ভাগ্যক্রমে পুরো গ্রামের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আমি মাটিতে ছিটকে পড়ি।

আজ এত দিন পর কথাগুলো বলছি বটে, কিন্তু ভাবলে শিউরে উঠি আজও। ঢাকা মেডিকেলে টানা ১১টি অস্ত্রোপচার, ২৮ থেকে ৩০ ব্যাগ রক্ত, ডান হাত কেটে ফেলা, শরীরের বিভিন্ন স্থানের চামড়া কেটে পোড়া অংশে লাগানো, ৩৯ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং আরও দুই মাস কেবিনে চিকিৎসাসহ নিদারুণ কষ্টের সেই সময়। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায় কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। প্রথম এক মাস আমার ঝুঁকি ছিল। চিকিৎসকেরা সরাসরি যেকোনো মুহূর্তে আমার মৃত্যুর আশঙ্কার কথা বলতেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই যুদ্ধে কাছে পেয়েছি আমার কিছু বন্ধু, বড় ভাই ও অনেক প্রিয়জনকে। সে যাত্রায় দীর্ঘ চার মাস পাহাড়সম কষ্ট পাড়ি দিয়ে জীবনের সংকট কাটিয়ে বাসায় ফিরে যাই একটি অপূর্ণ শরীর ও দুটি বিকল পা নিয়ে। ইতিমধ্যে ৩৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় এবং আমি উত্তীর্ণ হই। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নটা হাতছাড়া করতে চাইনি। কেবলই অদম্য মনোবলকে পুঁজি করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকি। অবশেষে হুইলচেয়ারে ভর করেই মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি।

কয়েক মাস পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের তামিলনাড়ুতে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেলে ভর্তি হই। আত্মীয়–পরিজনহীন বিদেশে মা ও দুই ভাইকে নিয়ে শুরু হয় আরও কঠিন যুদ্ধ। সেখানে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে ৮টি অস্ত্রোপচার, ডান পা কেটে ফেলা এবং বাঁ পায়ে ১২টি লোহার স্টিক আমাকে আরও এক ধাপ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু আমার অসহায় পরিবারের জন্য আমাকে তো বাঁচতে হবে। আমি নিজের মধ্যে নতুন করে শক্তির সঞ্চার করি। ভারতের চিকিৎসকেরা আমার হাঁটার ব্যাপারে একেবারেই আশাবাদী ছিলেন না। কিন্তু ফিজিক্যাল মেডিসিন ও পুনর্বাসনের পর কৃত্রিম পা দিয়ে আমি নতুন করে হাঁটতে শিখি।

দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে ৩৬তম বিসিএসের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা (নন-ক্যাডার) হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। শুধু হারানোর ভারে আক্রান্ত জীবনে এই প্রাপ্তি আমার স্বপ্নের পালে এক জোর হাওয়া যেন। চাকরির শুরুতে শারীরিক অযোগ্যতা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু চাকরিতে যোগদানের পর আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সহকর্মীদের নিঃশর্ত সহযোগিতা আমার সেই দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছে। সিঙ্গেল হ্যান্ডেড সব ধরনের অফিশিয়াল দায়িত্ব আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করি।

মানুষের স্বপ্নের কি কোনো পরিসীমা আছে? যে হাত দিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম স্বপ্নের চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি, সেই হাত আমি দেখি না কত দিন! আহা, আমার ফুটবলপ্রিয় পা; দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আলগোছে। কিন্তু স্বপ্ন? হ্যাঁ, পুড়েছিল বটে, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে দিইনি। আমার পরিবার, বন্ধু-পরিজন আর অজস্র মানুষের ভালোবাসাকে বুকে ধরে স্বপ্নের পথে হেঁটে গেছি আমি। এখনো বিভিন্ন শারীরিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে শান্তি খুঁজে পায়, তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা আমাকে জাগিয়ে রাখে। আমি জেগে থাকি। আমি জানি, এক জীবনযুদ্ধ করার জন্য ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না। বিশ্বাস করি, একদিন সবুজ মাঠে কৃত্রিম পায়ে বল নিয়ে দৌড়াব। কাটা হাতে পোড়া শরীরে বিলাব মুঠো মুঠো স্বপ্ন! এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমার ইচ্ছাকে পঙ্গু করতে পারবে না!

মো. ইউনুস। ছবি: ছুটির দিনে
মো. ইউনুস। ছবি: ছুটির দিনে

গাড়ি চালান সতর্কতার সঙ্গে
মো. ইউনুস                                                                                                   
অটোরিকশাচালক, ভোলা

আমার বাড়ি ভোলার সদর উপজেলার উত্তর জয়নগর জয়গুপি গ্রামের গজারিয়া বাজারের কাছে। একসময় আমি আন্তজেলা ট্রাক চালাতাম। সারা দেশে মালবোঝাই গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। চোখের সামনে কত দুর্ঘটনা দেখেছি। কিন্তু নিজেও এমন দুর্ঘটনার শিকার হব, তা কখনো ভাবিনি। কারণ, সব সময় সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করতাম।

২০০৯ সালের কথা। চট্টগ্রাম থেকে ট্রাক নিয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি সেতুর কাছে এসেছি তখন। বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। ছিটকে পড়ি পাশের ডোবায়। সেখানেই বাঁ পা ছিঁড়ে যায়। উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর কেটে ফেলতে হয় পা।

আমার বয়স এখন ৪৮ বছর। সংসারে তিন ছেলে, এক মেয়ে। এক ছেলে, এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ১১ বছর আগের সেই ঘটনায় আমার পুরো পরিবার পথে বসেছিল। তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ ছিলাম আমি। সে সময় অনেক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠি। সুস্থ হলেও কিছু করতে পারছিলাম না। ছয়জনের সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে ভিক্ষার থালা হাতে তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। কোনোরকমে দিন কাটতে থাকে। নানা মানুষও কটু কথা বলে। ভোলার মানুষ আর বিভিন্ন সংস্থা ভালোবেসে সহায়তায় আমার পাশে দাঁড়ায়।

২০১৫ সালের শেষের দিকে ভোলার বেসরকারি সমিতি গ্রামীণ জন-উন্নয়ন সংস্থার সুদহীন ঋণের টাকায় একটি বোরাক (ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা) কিনি। গাড়ি চালিয়ে কিস্তিতে ঋণ শোধ করি। আমি গাড়ি চালিয়ে ভালো আছি। দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। এখন সেই গাড়ি চালিয়েই চলছে সংসার। মানুষের বাজে কথা শুনতে হয় না। আগে কষ্ট করে ভিক্ষা করতাম। এখন কষ্ট করে সৎ পথে আয় করি। মানুষ সম্মান করে এবং ভালোবাসে।

তবে সড়কে গাড়ি চালাতে গিয়ে বাস মালিক সমিতি আর পুলিশ ভীষণ সমস্যা করে। তারা প্রায়ই আমার গাড়ি আটকে দেয়। বলে, বড় রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারবে না। সব সময় বড় রাস্তায় আসি না, কিন্তু যাত্রী আসতে চাইলে নিষেধও করতে পারি না। আমি পঙ্গু মানুষ। গাড়ি আটকালে আমার সংসার চলবে না। ঘরে এখন চারজন খানেওয়ালা। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ। মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। তারা যেন আমার প্রতি মানবিক হয়।

আমার গাড়িটার বয়স চার বছরের ওপরে। অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। প্রায়ই সারাতে হয়। গাড়ি চালাতে কষ্টও হয়। যদি কেউ আরেকটি নতুন গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে ভালো হয়।

শেষে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে চালক ভাইদের বলব, সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে সবাই সাবধানতা অবলম্বন করবেন। আমি চাই না আমার মতো কষ্টের সময় আপনাদের জীবনে আসুক।

অনুলিখন: নেয়ামতউল্যাহ, ভোলা