মহামারি নারী আর পুরুষকে আলাদা চোখে দেখে

করোনা–আতঙ্কের মধ্যেই পোশাক কারখানার  শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে।  ছবি: সাদিক মৃধা
করোনা–আতঙ্কের মধ্যেই পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে। ছবি: সাদিক মৃধা

যেকোনো সংক্রামক ব্যাধি থেকে নিজেকে রক্ষা করার একটি বড় উপায় হলো আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, যা নারীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আর তাই সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোও কঠিন তাঁদের পক্ষে।

 বিশ্বখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট ১৪ মার্চ অনলাইন সংখ্যায় বলছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন বা স্বাস্থ্যসেবা লাভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকেন নারীরা। 

এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্রে কোনো তফাত না করেই হানা দিয়ে যাচ্ছে, বরং চীনের লব্ধ তথ্য-উপাত্ত বলছে, নারীদের তুলনায় পুরুষেরাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বেশি। তবু নারীর ওপর এর সামগ্রিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী বলেই মনে করে ল্যানসেট। এই তফাত ভাইরাসসৃষ্ট নয়, বরং বেশিটাই আর্থসামাজিক। 

একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সে দিন কথায় কথায় বলছিলেন বাংলাদেশে সিডরের সময় একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ডায়রিয়া উপদ্রুত অঞ্চলে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা। সেখানে একটি কুঁড়েঘরে এক মেয়েশিশু যখন ডায়রিয়ায় ভুগছিল, তখনো মা ঘরে থাকা স্যালাইনের প্যাকেটটি সযত্নে তুলে রেখেছিলেন তাঁর ছেলেশিশুটির জন্য। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে ফিরে প্রবাসী তরুণেরা ঘটা করে বিয়ে করছেন, করোনার মারাত্মক ঝুঁকির কথা জেনেও কনের বাবা নিজের মেয়েকে এই সময় প্রবাসী পাত্রের ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছেন না! মেয়ের বাঁচা-মরা নিয়ে কে ভাবছে? এই যে ইতালি, মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশ থেকে দলে দলে করোনা ভাইরাসবাহী পুরুষ দেশে ফিরলেন, তাঁরা কি একই ঘরে একই বিছানায় স্ত্রীসঙ্গ উপভোগ করতে দ্বিধা করছেন একবারও? স্ত্রীর স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভাবছেন কি? তারপর পরিবারে মা-বাবা বা শিশুসন্তানটি অসুস্থ হলে বাকি সবাই আইসোলেশনে গেলেও বেচারা নারীটির সে ভাগ্য হবে না। কেননা বাসার যেকোনো অসুস্থ মানুষের পরিচর্যা তাহলে কে করবে? 

 নারীর কর্মক্ষেত্রের নীতিনির্ধারকেরা বারবার বলছেন জনসমাগমে না যাওয়ার কথা, ভিড় এড়িয়ে চলার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত (শনিবার) কারও মুখে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা শুনলাম না তো? কারখানা খোলা রেখেও স্বাস্থ্যঝুঁকি কীভাবে কমানো যেতে পারে, সে বিষয়ে শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া কোনো সংগঠন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি? আর যদি কখনো এমন খারাপ দিন আসে যে কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে, তখন এই নারীরা কি চাকরি হারাবেন নাকি কর্তৃপক্ষ তাঁদের বেতন-সুবিধাদি বজায় রাখবে? 

এদিকে রাজধানীর ফ্ল্যাটগুলোর বেশির ভাগ গৃহকর্ত্রী ছুটা গৃহকর্মীকে আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। গৃহকর্মী আসছেন না, ফলে ঘরের কাজ করতে হচ্ছে বাড়ির ওই গগৃহকর্ত্রীকেই।

 অর্থনীতিবিদ হেলেন লুইস সম্প্রতি করোনা দুর্যোগ নিয়ে আটলান্টিক গ্লোবাল পত্রিকায় বলছেন, এটা শুধু একটা জনস্বাস্থ্য ক্রাইসিস-ই নয়, অর্থনৈতিক সংকটও বটে, আর এই ক্রাইসিসে শেষ অবধি সবচেয়ে বেশি ভুগবেন নারীরাই। 

মহামারি নারী আর পুরুষকে আলাদা চোখে দেখে। গতকালই বহুজাতিক অফিসে কর্মরত (বর্তমানে বাসায় বসে অনলাইনে অফিসের কাজ করছেন) এক বন্ধু ফেসবুক পোস্টে সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর অভাবনীয় মুহূর্তগুলো তুলে ধরেছেন। সেই ছবিতে তাঁর স্ত্রীর উপস্থিতি নেই! স্টে হোম, স্টে সেইফ—স্লোগানও বুঝি নারী-পুরুষের জন্য আলাদা দ্যোতনা বহন করে। 


তানজিনা হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ।