আমরা এক দল, লড়ছি একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে : শচীন টেন্ডুলকার

>করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রক্রিয়াকে টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা করেছেন ভারতের কিংবদন্তি খেলোয়াড় শচীন টেন্ডুলকার। সম্প্রতি এই খ্যাতনামা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ভারতীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানেই তিনি বলেন, কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হলে আমাদের টেস্ট ক্রিকেটের কলাকৌশলগুলো মনে করে রাখতে হবে। বিশ্বের সব দেশকে খেলতে হবে এক দলের হয়ে।
শচীন টেন্ডুলকার
শচীন টেন্ডুলকার

ক্রিকেট এক অভিনব খেলা। ভক্তদের আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য বেশির ভাগ খেলাকেই আরেক খেলার সঙ্গে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিতে হয়। কিন্তু ক্রিকেট এমন এক খেলা, যাকে পাল্লা দিতে হয় এরই নানা ধরন ও নানা সংস্করণের সঙ্গে। ইদানীং প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে, দ্রুতগতির এই টি-টোয়েন্টির যুগে টেস্ট ক্রিকেট কতটা গ্রহণযোগ্য? কতটা প্রাসঙ্গিক? এখন যখন পুরো বিশ্ব লড়াই করছে কোভিড-১৯ মহামারির সঙ্গে, ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরোনো আর নির্ভরযোগ্য এই ধরন থেকে কিছু অমূল্য শিক্ষা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

আপনি কিছু একটা জানেন না; এই অজ্ঞতাকে মেনে নেওয়ার জন্য টেস্ট ক্রিকেটে আপনি পুরস্কৃত হতে পারেন। খেলার এই ধরন আপনাকে ধৈর্যের মূল্যায়ন করতে শেখায়। যখন আপনি পিচের অবস্থা কিংবা বোলারের গতি বুঝতে পারছেন না, তখন খেলায় আত্মরক্ষাই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বর্তমান পরিস্থিতিতে, এই মুহূর্তে আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটের মতো এখানেও এই ধৈর্য এখন আমাদের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ। ক্রিকেটার হিসেবে, সর্বোপরি মানুষ হিসেবে, আমি কোনো দিন ভাবিনি যে আমাকে এমন দিনও দেখতে হবে। ভারত, এমনকি সারা বিশ্বে ক্রিকেট স্থবির হয়ে আছে।

একটি ক্রিকেটীয় রূপক ব্যবহার করতে চাই। টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য আসে পার্টনারশিপ আর দলগত চেষ্টায়, যেখানে এই খেলার স্বল্পব্যাপ্তির ফরম্যাটগুলোয় জয় আসতে এক বা দুজনের ভালো পারফরম্যান্সই যথেষ্ট। যদি একজন ব্যাটসম্যান সহজ ওভার পায় আর এরপর তার সঙ্গীকে ঠেলে দেয় আক্রমণাত্মক বোলারের মুখে, তাহলে হয়তো ওই এক ব্যাটসম্যান রানের প্রাচুর্য গড়তে পারবে, থাকবে অপরাজিত; কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়বে পুরো ইনিংস। এটা এই সময়ের জন্য খুবই উপযুক্ত একটা শিক্ষা।

নভেল করোনাভাইরাস এমন এক রোগ, যার অনেক রহস্যই এখনো এই পৃথিবীর মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না। আমরা দেখছি, অনেক দেশেই হু হু করে বেড়ে চলছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। কারণ, ওই দেশগুলো ঠিক সময়ে প্রতিরোধের সঠিক ব্যবস্থাটি নেয়নি। যদি নিজের ঘাটতি স্বীকার করে নেওয়ার খেলোয়াড়সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি আমরা গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে হয়তো এই রোগের সঙ্গে লড়াইটা এত ক্লান্তিকর হতো না।

আমাদের শুধু নিজের কথা ভাবলেই হবে না। চারপাশে যারা আছে, তাদের সবার কথা ভাবতে হবে। সবার কথা ভেবে আরও সচেতন ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। আমাদের অনেকেরই হয়তো রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা ভালো। এটা ভেবে যদি আমরা ভাইরাস ঠেকানোর জন্য কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমরাই হয়ে উঠতে পারি করোনাভাইরাসের বাহক। আর তা ছড়িয়ে দিতে পারি বয়স্ক ব্যক্তিদের শরীরে, কিংবা এমন কারও মধ্যে, যার শরীরে এই রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা নেই।

টেস্ট ক্রিকেটে একবার পিছিয়ে গেলেও আবার ফিরে আসা যায়। প্রথমটায় ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় ইনিংস তো আছেই। একেকটা দেশ এখন করোনাভাইরাস মোকাবিলার একেক পর্যায়ে আছে। ইতিবাচক মানসিকতা ধরে লড়াই চালিয়ে গেলে এই মহামারিকে যে যার অবস্থান থেকে আমরা হারাতে পারব। প্রতিটি দেশকেই এখন ভাবতে হবে, আমরা লড়ছি এক দলের হয়ে, একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এক দলের খেলোয়াড়ের মতো প্রতিটা দেশকেই এখন আরেক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে, কথা বলতে হবে, একে অন্যকে সাহস জোগাতে হবে। লড়াই করে একটি ক্লান্ত দিনের শেষে একে অন্যের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতে হবে সতীর্থের মতো। অনুপ্রেরণা দিতে হবে, যেন আগামী দিনের যুদ্ধে আরও বেশি মনোবল, আরও বেশি জোর নিয়ে ময়দানে নামতে পারে একেকজন।

আজ বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী, হাসপাতাল আর গবেষণাগারের চিকিৎসক, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সাহসিকতার প্রশংসা করার পাশাপাশি নিজেরা সচেতন হয়ে তাঁদের ওপর থেকে চাপ কমানোর দায়িত্বটাও কিন্তু আমাদের। এতে তাঁরা একটু সময় পাবেন। নিজেদের সামলে তাঁরা আরও গতিশীল হতে পারবেন। আমরা যদি অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ ও সামাজিক জমায়েত থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারি, তাহলে কোভিড-১৯ রোগনির্ণয়ের পরীক্ষার চাপও কমে যাবে। তখন সম্মুখ সমরে থাকা চিকিৎসকেরা সেই সব সংকটপূর্ণ রোগীদের সময় দিতে পারবেন, যাঁদের দ্বিগুণ সেবা ও শুশ্রূষা প্রয়োজন। যদি আমরা ঘরে থাকায় কমে যায় নতুন করে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা, তাহলে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরাও সময় পাবেন এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। নিজেদের পুরোপুরি নিয়োজিত করতে পারবেন গবেষণায় এবং এই করোনাভাইরাসের সব রহস্য উন্মোচনে।

মনে রাখতে হবে, কোভিড-১৯–এর বিষাক্ত বিস্তার তখনই দমানো যাবে, যখন শুধু আমি একা না, আমরা সবাই নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখব, যখন আমরা সবাই নিয়মিত নিজেদের স্যানিটাইজ করব।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো চলুন সবাই মেনে চলি। এই মহামারি আমাদের সত্যিকারের চারিত্রিক পরীক্ষা নিচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই দুর্যোগ আমাদের কাছাকাছিও নিয়ে এসেছে। এই লড়াইয়ে আমাদের এক দলে থেকে ধাপে ধাপে ধৈর্যের সঙ্গে এগোতে হবে আর এভাবেই একসময় আমরা জয়ী হব।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান, টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে