কানাডার করোনাযুদ্ধের অগ্রভাগে এক বাংলাদেশি

সাফি ভূইয়া। ছবি: সংগৃহীত
সাফি ভূইয়া। ছবি: সংগৃহীত

টরন্টোর শীর্ষস্থানীয় একটি নিউজ পোর্টালে বেরিয়েছে খবরটা। এই শহরের একদল গবেষক মিলে তৈরি করেছেন একটি বিশেষ করোনা মানচিত্র। সচল এই মানচিত্রের মাধ্যমে বোঝা যাবে বৃহত্তর টরন্টোর কোন এলাকায় করোনা সংক্রমণ কী মাত্রায় হয়েছে। খবরটা পড়া শেষে হয়তো ভুলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই চোখ আটকে গেল এক জায়গায়। যেখানে লেখা—এই মানচিত্র তৈরিতে কাজ করা গবেষক দলকে নির্দেশনা দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর বিশ্ব জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সাফি ভূইয়া! এই ডক্টর সাফি ভূইয়া বাংলাদেশি নন তো?

কানাডার টরন্টো শহরজুড়ে চলছে জরুরি অবস্থা। অতএব অনলাইন দুনিয়ায় খোঁজ। এখানে–ওখানে খুদে বার্তা আদান–প্রদান চলল অনেক। সন্ধ্যার দিকে যখন হাল ছেড়ে দেব ভাবছি, তখন মুঠোফোন বাজল। ফোনের ওপাশে বাংলাভাষী একজন বলেন, ‘ভাই, সাফি বলছিলাম। কিছু মনে করবেন না, কাজের খুব চাপ। আপনার মেসেজ পেয়েছি।’

হ্যাঁ, ফোনের ওপাশেই সাফি উল্লাহ ভূইয়া। জন্ম নরসিংদীর রায়পুরায়। গ্রামের নাম মতিনগর। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। এরপর কাজের জন্য ছুটেছেন নানা দেশে। এক দশক হতে চললে থিতু হয়েছেন টরন্টোতে।

এখন কানাডিয়ান কোয়ালিশন ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের বোর্ড চেয়ার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটির আইটিএমডি পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং প্রোগ্রামের সহপ্রতিষ্ঠাতা। মানবসেবায় অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক লায়নসের ‘মেলভিন জোনস ফেলো’ ও ‘হেলেন কেলার ফেলো’ নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় খবর, কানাডা কোভিড-১৯ রেসপন্স টিমের সহনেতৃত্বে আছেন এই বাংলাদেশি কীর্তিমান।

মেয়ে নাফিসা ভূইয়া বাবার মতোই পড়ছেন চিকিৎসাশাস্ত্র। ছেলে মুফরাত ভূইয়া পড়ছেন ব্যবসায় প্রশাসন। স্ত্রী নাহিদ কোরেশী কাজ করছেন অন্টারিও রাজ্য সরকারের একটি ক্লিনিকাল ডেটা রিসার্চ প্রকল্পের প্রধান হিসেবে। পৃথিবীর এই কঠিন সময়ে কত প্রশ্ন মনে করোনা নিয়ে। ইচ্ছে হলো, যাবতীয় প্রশ্ন সব করে ফেলি সাফি ভূইয়াকে। সেই সব প্রশ্নের কিয়দংশের জবাব এখানে—

কানাডিয়ান পাবলিক হেলথ কোয়ালিশন ফর কোভিড রেসপন্স দলের সহনেতৃত্বে আছেন আপনি। এটি মূলত কী ধরনের কাজ করছে?

আমাদের কাজ বহুমুখী। এর  মধ্যে আছে অন্টারিও টেলিহেলথ সেবা কার্যক্রমকে সহায়তা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণে রাখা, আইসোলেশনের সঠিক নির্দেশনা দেওয়া, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে নির্দেশনা দেওয়া—এসব। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে দ্রুত কার্যকরী পদ‌ক্ষেপ নিয়ে পুরো কানাডায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনা।

বিশেষ মানচিত্রটি কীভাবে করোনা প্রতিরোধে বা সচেতনতা তৈরিতে কাজে লাগবে?

এই মানচিত্র প্রকল্পটির নাম আমরা দিয়েছি ‘ফ্ল্যাটেন’। এটিকে পুরো কানাডার নিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ কোভিড-১৯ রোগীদের তথ্যসহ একটি ডেটাবেইসও বলতে পারেন। এই হিট ম্যাপটি তৈরি করা হয়েছে মূলত কানাডার সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে  প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে। আমরা এর মাধ্যমে কোভিড-১৯–এর বিস্তৃতির বক্ররেখাকে সরলরেখা (ফ্লাটলাইন) করতে সহযোগিতা করতে পারব বলে আশাবাদী। এটি জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য কোনো এলাকায় হাসপাতালগুলোর কী মাপের প্রস্তুতি দরকার, সেটি বুঝতেও কাজে লাগবে। এই মানচিত্র থেকে আপনি পুরো কানাডা বা টরন্টো তো বটেই, এমনকি ঠিক আপনার বাড়ির আশপাশের এলাকায় করোনা পরিস্থিতি কী, সেটাও খুব সহজে বুঝতে পারবেন।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র অর্ধশতর মতো রোগী শনাক্ত হয়েছে। তার মানে কি আমরা বলতে পারি বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কম?

বাংলাদেশে প্রশিক্ষিত জনশক্তি, পর্যাপ্ত টেস্ট কিটস, সেবা প্রদানকারীদের নিরাপত্তা আর দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে বলে আমার মনে হয়। রোগীর সংখ্যা এখনো কম বলে বিপদমুক্ত আছে, এটা বলা মুশকিল।

বাংলাদেশিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্য দেশের মানুষের চেয়ে বেশি বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এটি কতটুকু সত্য?

আমি মনে করি, এ রকম কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। যাঁরা এটা অনুমান করছেন, তাঁরা এটা কীসের ভিত্তিতে করছেন, আমার পরিষ্কার ধারণা নেই।

বাংলাদেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে আপনার পরামর্শ কী?

সবার আগে দরকার মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। আমার দেশের সবাইকে বলব ঘরে থাকতে এবং সামাজিক দূরত্ব বা অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলতে।