শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা

চার ইন্টার্ন চিকিৎসক— (বাঁ থেকে) তাহমিনা আহমেদ, মো. হাসিবুল ইসলাম, সাদিয়াতুল মুনতাহা ও দিদারুল আলম
চার ইন্টার্ন চিকিৎসক— (বাঁ থেকে) তাহমিনা আহমেদ, মো. হাসিবুল ইসলাম, সাদিয়াতুল মুনতাহা ও দিদারুল আলম
>মাত্রই পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে দীক্ষা নিতে শুরু করেছেন, এরই মধ্যে এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালের শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) চিকিৎসকেরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই সময়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করা এমন কয়েকজনের অভিজ্ঞতা শুনুন।

ভয় পাওয়ার জন্য আসিনি

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিট-২। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত তিনটা ছুঁই–ছুঁই। একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক দ্বিতীয় তলায় নারী রোগীদের গ্রহণ করছিলেন। আমার দায়িত্ব ছিল নিচতলায় পুরুষ রোগীদের দেখা। রোগী এবং তাঁদের সঙ্গে আসা মানুষ মিলিয়ে ৯-১০ জন আমার টেবিলের সামনে।

বহির্বিভাগের একজন রোগী এলেন। তাঁর বয়স ৪৫। তিনি শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা আর জ্বর নিয়ে এসেছেন। বুকে ব্যথা ছিল বলে জরুরি বিভাগ থেকে হার্টের কোনো সমস্যা থাকতে পারে ভেবে সিসিইউতে পাঠানো হয়, কিন্তু ইসিজি স্বাভাবিক থাকায় তাঁকে আবার মেডিসিনে পাঠিয়ে দিই। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ‘ব্রেথ সাউন্ড’ পেলাম, তাই এক্স–রে করতে পাঠালাম।

প্রায় ৩০ মিনিট পর তিনি এক্স–রে ফ্লিমসহ হাজির হলেন। এক্স–রেতে বাইলেটারাল কনসলিডেশন পাওয়া গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কী করেন? রোগীর স্ত্রী বললেন, তিনি সৌদি আরবে থাকতেন, ২০ দিন হলো এসেছেন।

এবার আমি দুশ্চিন্তায় পড়লাম। লোকটির মুখে মাস্ক নেই, আমারও নামমাত্র একটি মাস্ক ছাড়া কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা নেই। তখনো আমাদের হাসপাতালে করোনা বা আইসোলেশন ইউনিট চালু হয়নি। সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। তিনি বললেন, ‘যেহেতু করোনার আশঙ্কা আছে, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা দাও। আইইডিসিআরের (রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলো, আর কুর্মিটোলা হাসপাতালে রেফার্ড করো।’ আমি তা-ই করলাম, আর রোগীর সঙ্গে থাকা একজনের ফোন নম্বর রাখলাম।

এরপরের কয়েক দিন নিয়মিত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কারণ, একে তো তাঁর কোনো নিরাপত্তা ছিল না, এর ওপর তিনি সিসিইউ, রেডিওলজি, সব বিভাগ ঘুরে এসেছেন। সেখানে চিকিৎসক, নার্স, রোগীসহ কত মানুষ—সবাই সংক্রমিত হতে পারেন। দুদিন পর জানলাম, তাঁর করোনা পরীক্ষা নেগেটিভ এসেছে।

মা-বাবা-আপু, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা থেকে শুরু করে সহপাঠী—সবাই বলেন, যেন সাবধানে থাকি, যেন যথাযথ সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করি। এমনকি কয়েক দিনের জন্য ছুটি নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু আমার সব সময় মনে হয়েছে, সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে দিয়ে এই ডাক্তারি পেশায় যখন এসেছি, কোনো কিছুকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য তো নয়। সেটা হোক ভাইরাস বা অন্য কিছু।

রোগী পালিয়ে গিয়েছিলেন

ছোটবেলা থেকেই মহামারি শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ছিল। নানা-নানির কাছে শুনেছি, আমাদের দেশেই কীভাবে কলেরা, গুটিবসন্তে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। মেডিকেলে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ‘কমিউনিটি মেডিসিন’ পড়তে গিয়ে প্যানডেমিক বা মহামারির সংজ্ঞা জানা হলো। কিন্তু তখন কল্পনাও করিনি, এই যুগে এসেও সারা পৃথিবীকে ওলটপালট করে দেওয়া এমন মহামারি দেখতে হবে।

রাজধানী থেকে দূরে, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ করার সুবাদে বুঝেছি, আমাদের দেশে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতার কতটা অভাব। এ রকম একটা সময়েও হাসপাতাল মানেই একজন রোগীর সঙ্গে কমপক্ষে সাত-আটজন দর্শনার্থী! এতে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হন। যে সময়টাতে যথাসম্ভব ঘরে থাকা প্রয়োজন, সেই সময়টাতেও অনেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন।

নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের মতো শত শত ইন্টার্ন চিকিৎসক নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ন্যূনতম পিপিই (পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) থাকুক কিংবা না থাকুক, দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা হইনি। সপ্তাহখানেক আগে একজন রোগী রিসিভ করার সময় তাঁর শারীরিক উপসর্গগুলো শুনে করোনাভাইরাসের লক্ষণের সঙ্গে যথেষ্ট মিল পাচ্ছিলাম। সতর্কতা ও চিকিৎসার অংশ হিসেবে রোগীকে আইসোলেশন ইউনিটে রাখতে চাইলে তিনি কৌশলে কাগজপত্রসহ পালিয়ে যান। ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম তাঁর কাণ্ডজ্ঞান দেখে। অন্তত নিজের এবং নিজের পরিবারের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাঁর সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি ছিল।

এ রকম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও মা-বাবা সব সময়ই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য এত ঝুঁকির মধ্যেও দায়িত্ব পালন করতে কখনো সাহসের কমতি হচ্ছে না।

এটি অসুখ, অভিশাপ নয়

কিছুদিন আগের কথা। দুপুরবেলার রাউন্ড শেষ করে চিকিৎসক কক্ষে বসে আছি, এমন সময় জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা মা। এ সময় যদিও পিপিই পরেই রোগী দেখার কথা। কিন্তু আমাদের হাতে তখনো শুধু গ্লাভস আর মাস্ক পৌঁছেছে। তা নিয়েই রোগী দেখলাম। রোগীর ইতিহাস শুনলাম, পরীক্ষা–নিরীক্ষা করলাম। বুঝলাম, তাঁর সিওপিডি (দীর্ঘদিন ধোঁয়া বা সিগারেটের কারণে ফুসফুসে সৃষ্ট রোগ)। বারবারই প্রশ্ন করছিলাম, তিনি বা তাঁর পরিচিত কেউ বিদেশফেরত কি না। রোগীর স্বজনেরা সবাই শিক্ষিত। বারবার বলছিলেন, না, তেমন কিছু নয়। তবে মনে হচ্ছিল, তাঁরা যেন একটা কিছু গোপন করছেন।

যা হোক, রোগীকে কেবিনে নেওয়া হলো। সে রাতে আমার ডিউটি ছিল। রাত চারটার দিকে গিয়ে দেখি রোগীর শ্বাসকষ্ট, জ্বর আছে। তবু বলছেন, এখন একটু ভালো বোধ হচ্ছে। আমার সন্দেহ হলো।

পরদিন আমাদের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, দুজন ইন্টার্নসহ রোগীর কাছে গেলাম। তাঁরা বললেন, তাঁরা তথ্য গোপন করেছিলেন। রোগী ওমরাহ করতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সতর্ক করা হলো। সুপার স্যার স্যাম্পল পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। আমিসহ ওই রোগীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হাসপাতালের ১৪ জনকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হলো। পরে জানা গেল, সেই রোগীর রিপোর্টে করোনা পজেটিভ এসেছে।

এখন তিনি সুস্থ হয়েছেন। আমরাও সুস্থ আছি। আমি কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় শিক্ষকেরা ফোন করে সাহস দিয়েছেন, সব সময় খোঁজ নিয়েছেন।

সবাইকে বুঝতে হবে, করোনা একটা অসুখ, এটা কোনো অভিশাপ নয়। উপযুক্ত চিকিৎসা নিলে এই অসুখ সেরেও যায়।

এখন অপেক্ষার দিন

আমাদের দেশে তখনো নিশ্চিতভাবে করোনায় আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন মাত্র দুই কি তিনজন। ওয়ার্ডেও বেশ কিছুদিন ধরেই সবার মধ্যে করোনার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছিল। আমরা বিভিন্ন নিবন্ধ পড়ছিলাম, পরবর্তী নির্দেশনা কী হবে, চিকিৎসাপদ্ধতি, মৃত্যুহার, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কী করণীয়—এসব নিয়ে আলোচনা চলছিল।

এমনই এক দিনের কথা। সেদিন ছিল শুক্রবার, বহির্বিভাগ বন্ধ। তবে রোগীর সংখ্যা কম নয়। আমার মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। রোগী দেখছি একজন। শুরুতেই তাঁর সমস্যা জানতে চাইলাম। রোগী বলতে শুরু করলেন, তাঁর জ্বর, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে দুদিন ধরে। তিনি সমস্যা বলছেন, আর আমার মাথায় আসছিল নানা রোগের নাম।

বলে রাখা ভালো, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় রোগীদের ‘ট্রাভেলিং হিস্ট্রি’ নিতে শুরু করেছিলাম আমরা। বিশেষ করে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকলে তো বিস্তারিতভাবেই নিতাম। স্বভাবতই তাঁর ভ্রমণ ইতিহাস জিজ্ঞেস করার পর তিনি জানালেন, সাত দিন আগে ইতালি থেকে এসেছেন। এবার আমার হাতে থাকা টিকিটটার দিকে তাকিয়ে দেখি, এক কোণে লেখা আছে, রোগী ইতালিফেরত।

আমার মাথায় তখন অন্য সব রোগের নাম সরে গিয়ে একটা নামই এল। একজন সিনিয়রকে জানালাম। তিনি এসে সব শুনে রোগীকে আইইডিসিআরে পাঠালেন। আমি তখন ভাবছি, এই রোগী জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট করে, পুরোনো ভবন পার হয়ে, নতুন ভবনের লিফটে এত মানুষের সঙ্গে গাদাগাদি করে সাততলায় এসেছেন, আবার একইভাবে ফিরে গেছেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হলে কী হবে?

পরদিনই আমার একজন সিনিয়র জানালেন, ওই রোগীর কোভিড-১৯ পজেটিভ! আমাকে ও সিনিয়র মেডিকেল অফিসারকে কোয়ারেন্টিনে যেতে হলো।

১৪ দিন বাসার একটা ঘরে একরকম বন্দী ছিলাম। প্রথম দিন সবাইকে বোঝাতে কষ্ট হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি সবার জন্য সম্পূর্ণ নতুন। শুরু হলো কোয়ারেন্টিনের দিন। ভয় ছিল নিজেকে নিয়েও, জানি না ওই ১৪ দিনে কী হতে পারত।

সেই সময়টাতে শিক্ষক, সিনিয়র, সহপাঠী—সবাই সাহস দিয়েছেন। আমিও এই কয়টা দিনে আবিষ্কার করলাম, যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মনোভাব আমার মধ্যে আছে।

এখন ভালো আছি, সুস্থ আছি। আর অপেক্ষায় আছি, কবে পৃথিবী সুস্থ হবে, আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।