'তোর সুরে আর তোর গানে, দিস সাড়া তুই ওর পানে'

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

কথাগুলো রবিঠাকুরের। ঘোর কালবৈশাখীর কথা ভেবে তিনি লিখেছিলেন এই ছত্র। আকাশ কালো করে আসা ঝড়ের মুখেও ‘সাড়া’ দিতে বলেছিলেন বিশ্বকবি। এই পয়লা বৈশাখে ‘সাড়া’ দেওয়া খুবই প্রয়োজন। সময় ও পরিস্থিতি বুঝে সুর ও গান নাহয় আমরাই বেছে নিই।

এ দেশে আজকাল কয়েকটি শব্দ বেশি শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে ‘আক্রান্ত’, ‘মৃত্যু’, ‘সাহায্য’, ‘ত্রাণ’, ‘চুরি’ ইত্যাদি। এসব শব্দ আমাদের আরও ভীত করে তুলছে। করোনাকালে আমরা এখন ঘরবন্দী। এমন জীবনে যখন সামান্য ভয়ও প্রচণ্ড হয়ে ওঠে, তখন ওপরের শব্দগুলো আতঙ্ক জাগায় বৈকি। ঠিক অনেকটা শূন্য চরাচরে দাঁড়িয়ে ঝড়ের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করার মতো।

সময় যত খারাপই হোক, তারপরও কিন্তু ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। সেকেন্ড যাচ্ছে, মিনিট কাটছে, ঘণ্টা পেরোচ্ছে। আমরা দিন পার করছি। নতুন বছরও আসছে। হ্যাঁ, আজ পয়লা বৈশাখ। কিন্তু এই বৈশাখ ঠিক আগেকারগুলোর মতো নয়। মানুষ আজ ঘরেই বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটি পার করছে। বাইরে বের হয়ে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। বের হতে গেলেই কানে বাজছে ‘আক্রান্ত’ ও ‘মৃত্যু—এই দুটি শব্দ। চৈত্রসংক্রান্তিতে ক্রান্তিকাল চোখ রাঙাচ্ছে। জীবন বাঁচাতেই আজ ঘরে থাকা জরুরি। ঘরেই বরং হতে পারে বৈশাখের আবাহন।

তার আগে আসুন, বাকি শব্দগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির মানবিক সংকট বোঝায় ওই শব্দগুলো। ‘সাহায্য’ বলছে এ দেশের অনেক মানুষ আজ চরম বিপদে। খাবারের অভাবে আছেন তাঁরা। উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে জানা যাচ্ছে, ঘরে খাবার নেই নিম্ন আয়ের ১৪ ভাগ মানুষের। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ শতাংশ দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র্য আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মানুষের ‘ত্রাণ’ দরকার।

আবার সেগুলো হাপিস করে দেওয়ার মতো মানুষেরও অভাব নেই। থেমে নেই ‘চুরি’। সরকার অবশ্য বলছে, চোরদের ক্ষমা করা হবে না।

এর মধ্যেই চলছে অভুক্ত মানুষের হাহাকার। একজন প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছিল কিছুদিন আগে। বলেছিলেন, ‘ভাই, এমনে থাকলে না খাইয়া মইরা যামু।’ খুব আক্ষেপ ও অসহায়ত্ব ছিল তাঁর কণ্ঠে। শবে বরাতের রাতেও নাকি না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। শুনেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। কিছু সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা কি আর তাঁর আগামী দিনগুলোর রক্ষাকর্তা হতে পারবে? পারবে না। কারণ, সেই সাধ্য আমার মতো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নেই। এই অক্ষমতা আরও পোড়ায়, আরও কাঁদায়।

তবে আমার মতো সব নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা যদি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে সম্ভব। স্কুল-কলেজে আমরা বারবার একটি কথা শুনেছি, ‘একতাই বল’। করোনার প্রকোপ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, এই সংকটে ‘এক’ হতে হবে, ‘মানবিক’ হওয়ার বিকল্প নেই। ‘সহমর্মী’ হতেই হবে। তবেই ‘চুরি’ শব্দটা আর উচ্চারিত হবে না। কান্নার বদলে হাসি ফুটবে মুখে। এর জন্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে হবে না। শুধু পাশের মানুষটিকে বলতে হবে, ‘আমরা তো আছি।’ এই সাড়াটুকু দিতে হবে।

আবার নিয়ম মানলে ‘আক্রান্ত’ শব্দের ব্যবহারও কমে আসবে। ‘মৃত্যু’ বদলে চলে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে ‘সুস্থ’ হওয়ার খবর।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

এমন একটা সময় এসেছে, যখন দেশের অভাবগুলো প্রকট হচ্ছে। করোনা আমাদের শেখাচ্ছে, কখন কী করা উচিত ছিল। ঘাটতি যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, তেমনি চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে অসহায় মানুষের পাশে সত্যিকারের মানুষের দাঁড়ানোর গল্প। ওই দ্বিধাহীন মুখগুলো আমাদের জানাচ্ছে, এভাবেই আমরা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পারব। ভালোবাসা দিয়ে আবার হাসি ফোটাতে পারব।

এবারের নতুন বছর তাই আমাদের আশায় বাঁচার বছর। আমরা বাঁচব। আমরা-ই বাঁচাব।

রবিঠাকুরের কথায় বলতে গেলে,
‘বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে।
ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে॥
বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে
আজি এ বাদলে আকুল হাওয়ায় রে—
কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে॥

আসুন, সবাই এক হই। একে অন্যের সহায়ক হই। গ্লানি মুছে দিই, জরা ঘুচে যাক। একদিন অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাবেই।