করোনা থেকে ফেরা নাফিয়ার হাসপাতালের দিনগুলো

কোভিড-১৯
কোভিড-১৯

'করোনাভাইরাস বিস্তারের এই সময়ে মানুষ যখন দিশেহারা তখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে সেবা নিয়ে আমার প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না। তাই আমি যখন হাসপাতাল ছাড়লাম মনে হয়েছে, ভালোই সেবা পেয়েছি। চিকিৎসকেরা কাছে এসে খোঁজ নিয়েছেন। ভালোমন্দ পরামর্শ দিয়েছেন। নার্সরা নির্ধারিত জায়গায় ওষুধ রেখে গেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসায় কোনো খরচ করতে হয়নি।' 

কথাগুলো বললেন ডেকো গ্রুপে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কর্মরত ফয়েজ নাফিয়া রহমান। সম্প্রতি কোভিড–১৯ এ তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে সুস্থ হয়ে এখন বাসায় অবস্থান করছেন। পরে আরেনাফিয়কটা টেস্ট করার পর বলা যাবে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন কি না। হাসপাতাল থেকে ফিরেও পরিবারের অন্যদের সুরক্ষায় তিনি বাসায় সবার থেকে আলাদা এক রুমে থাকছেন ।

নাফিয়া বলেন, 'বাসা থেকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়েছে। শুধু প্রাথমিকভাবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে নিজের ব্যবস্থাপনা ও খরচে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) থেকেও পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেয়েছি। রাজধানীর টোলারবাগে করোনার রেড জোনে আমার বাসা হওয়ার কারণেও অন্যদের তুলনায় একটু বেশি সহযোগিতা পেয়েছি, তাও হতে পারে। তবে চিকিৎসা সেবা নিয়ে এটা সম্পূর্ণই আমার অভিজ্ঞতা ও মতামত।'

টেলিফোনে নাফিয়া বললেন, 'হাসপাতালে চিকিৎসক পেয়েছি, তাঁরা জানতে চেয়েছেন ভালো আছি কি না। এক ওয়ার্ডে আমিসহ পাঁচজন ছিলাম। একটি বিছানা খালি ছিল। আমাদের চার জনের অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। বেশি বয়স্ক যিনি ছিলেন, তিনি একটু বেশি অসুস্থ ছিলেন। নির্দিষ্ট একটি টেবিল ছিল, সেখানে সবার ওষুধ রাখা থাকত, কারও অবস্থা একটু খারাপ থাকলে অন্যরাই তাঁর ওষুধটা এনে দিতাম। এর মধ্যে হাসপাতালে দুজন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। তবে মনকে শক্ত রাখতাম, কারণ করোনা এমন একটি জটিল সমস্যা, যার সে অর্থে কোনো চিকিৎসা নেই। তাই নিজের মনোবল বাড়ানো সব চেয়ে জরুরি।'

নাফিয়া জানালেন, গত ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় কোভিড-১৯ এর টেস্টে পজিটিভ আসে। তারপর বেশ দ্বিধায় ছিলেন কোথায় চিকিৎসা করাবেন তা নিয়ে। যেহেতু তেমন কোনো উপসর্গ ছিল না, তাই আইইডিসিআরের একজন চিকিৎসকসহ পরিচিত অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাসায় যথাযথ নিয়মে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে বাসায় বাবা, মা, ছোট ভাগনেসহ অন্যদের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে হাসপাতালে ভর্তি হবেন বলে ঠিক করেন। আইইডিসিআরকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলে কুয়েত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের নম্বর দেয়। ওই হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর পর রাত সাড়ে ১১ টার মধ্যে তিনি পৌঁছে যান সেখানে। ওয়ার্ডের নির্ধারিত বিছানায় যাওয়ার আগেই এক চিকিৎসক নাফিয়ার সব তথ্য লিখে নেন।

হাসপাতালে যাওয়ার আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস সঙ্গে নিতে। নাফিয়া বললেন, 'আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে লোক এসে বাসা থেকে আমার স্যাম্পল নিয়ে যান। বাসায় থাকা অবস্থায়ই আমার গলা ব্যথা, জ্বর, কাশিটা কমে যায়। তাই মনে মনে ভেবেছিলাম করোনা নেগেটিভ আসবে। তবে আইইডিসিআর থেকে ফোন করে আমার নানা তথ্য নেওয়া শুরু করলে ভয়টা বাড়ে। পরে তো জানলাম আমি পজিটিভ। সেই মুহূর্তটিতে মনের যে অবস্থা হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পরিবারের অন্য সদস্যরা কান্নাকাটি শুরু করে। তবে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে সব জিনিস গুছিয়ে একাই অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াই।'

নাফিয়া হাসপাতালটিতে ছিলেন মোট ১০ দিন। নাফিয়া বললেন, করোনাকালে চারপাশে ভালো বা ইতিবাচক খবর কম। ছেলে বাবার লাশ নিচ্ছে না, মাকে জঙ্গলে ফেলে যাচ্ছে—এ ধরনের খবরে সবার মধ্যেই ভয় ঢুকে গেছে। বিশেষ করে হাসপাতালে মানুষ সেবা পাচ্ছে না , স্বজন পাশে থাকছে না—তা তো গণমাধ্যমে আসছেই।

তবে হাসপাতালে নাফিয়ার অভিজ্ঞতাটা খুব ভয়াবহ হয়নি বলে জানালেন। অনেকের স্বজনকেই দেখেছেন প্রিয়জনের পাশে থাকতে। নাফিয়া হাসপাতাল ছাড়ার আগ পর্যন্ত সাহায্যকারী স্বজনেরা কেউ করোনা পজিটিভ হয়েছেন বলে শোনেননি। নাফিয়া বললেন, করোনা পজিটিভ আসার আগে মার্চের ১৯ তারিখ তিনি শেষ অফিস করেছিলেন, এরপর থেকে বাসা থেকেই কাজ করছিলেন। মিরপুরের টোলারবাগের অবস্থা খারাপ হওয়ায় এরপর তিনি বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য ঘরের বাইরে যাননি। কিন্তু তারপরও নাফিয়া করোনা পজটিভ হয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর পরিবারের আর কোনো সদস্যের করোনা পজিটিভ আসেনি।

নাফিয়া হালকা গলা ব্যথা অনুভব করেন ৩ এপ্রিল। তারপর থেকে জটিলতা শুরু হয়, বাসায় থাকা অবস্থাতেই উপসর্গগুলো কমতেও শুরু করেছিল। হাসপাতাল থেকে বাসায় তিনি ফিরেছেন গত ১৭ এপ্রিল। হাসপাতালের অভিজ্ঞতা নিয়ে নাফিয়া গত ১৯ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাঁর নিজস্ব ওয়ালে একটি পোস্ট দেন। নিজের অভিজ্ঞতা লেখার পাশাপাশি চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধন্যবাদ দেন, একই সঙ্গে তিনি যে রোগীদের হাসপাতালে রেখে এসেছিলেন, তাঁদেরসহ সবার সুস্থতা কামনা করেন।

আজ ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নাফিয়ার ওই পোস্টে প্রায় ৯ হাজার লাইক এবং প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো শেয়ার হয়েছে। দু্ই শতাধিক কমেন্টে অনেকেই নাফিয়ার পোস্ট দেখে উৎসাহিত হয়েছেন, আবার অনেকে আসলেই নাফিয়া সেবা পেয়েছেন, না বাড়িয়ে লিখেছেন তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

নাফিয়া বললেন, 'আমি বারবার বলছি, এ অভিজ্ঞতা বা মতামত শুধুই আমার। অন্যদের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। বা হাসপাতালে সমস্যা নেই, তাও বলার উপায় নেই। আমি যেহেতু তেমন কোনো আশা নিয়ে হাসপাতালে যাইনি, তাই তেমনভাবে আশাহত হইনি।'

করোন থেকে ফেরা নাফিয়া বলেন, হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের সেবা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। কন্ট্রোল রুমে সকালে ফোন করে কিছু চাইলে সন্ধ্যায় পাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। ওয়ার্ডের ছয়জন রোগীর জন্য একটা টয়লেট, তাই সব সময় তা পরিষ্কার পাওয়া যাবে না তাই স্বাভাবিক। হাসপাতালটিতে তিন বেলা খাবারের বাইরে ভিটামিন সি জাতীয় কোনো খাবার দেওয়ার কোনো বাজেট নেই। আমি আমার সহকর্মীদের জানানোর পর অনেকেই হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থায় কমলা, মাল্টা পাঠিয়েছেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে এই সহায়তাটুকুও অনেক বড় পাওয়া বলে মনে করেছি। হাসপাতালটির করোনা ওয়ার্ডে এই ফাঁকা তো আবার পরের দিনই ভরে যাচ্ছে। চিকিৎসকসহ অন্যরাও এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। সব মিলিয়ে পরিবেশটাই তো এখন আর স্বাভাবিক নয়।

নাফিয়া বললেন, 'আমার ওয়ার্ডেই দেখেছি, বাড়ি থেকে স্বজনেরা ফোন দিলেই কান্নাকাটি শুরু করতেন। আমি তখন বলতাম যে এভাবে কান্নাকাটি করলে শ্বাসকষ্ট বাড়বে। আর আমরা রোগীরা যদি এমন করি, পরিবারের লোকজন তো আরও ভেঙে পড়বে। তাই কান্নাকাটি করে লাভ নেই। করোনা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ফাইট করতে হবে। নিজের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।'

নাফিয়া তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, 'আমাকে রিলিজ দেওয়ার আগের দিন এক ডাক্তার আমাদের বলেছিল, আপনারা রিলিজ নিয়ে চলে যাবেন, আর আমরা এখানে এডমিট হব। নাফিসা তাঁর পোস্টে কারও যদি করোনার উপসর্গ থাকে, তবে তিনি যাতে তা না লুকিয়ে রাখেন বা গোপন না করেন, সে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এতে তাঁর স্বজনসহ চিকিৎসকেরাই সংক্রমিত হচ্ছেন, আর এই পরিস্থিতি চিকিৎসকেরা সংক্রমিত হওয়া শুরু করলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে, তাও অনুধাবন করার আহ্বান জানিয়েছেন।