সব বিষয়ে জানার চেষ্টা থাকতে হবে : জামিলুর রেজা চৌধুরী

>গত ২৮ এপ্রিল চলে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন গবেষক, প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী। উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে মাসিক বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছিলেন নানা বিষয়ে। পড়ুন তারই কিছু অংশ।
জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন যাঁদের
শুধু পড়াশোনা করলেই যে আসলে স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব, এমনটা নয়। আমি কিন্তু আমার অনেক সহপাঠীর চেয়ে কম সময় ক্লাসের পড়াশোনা করেছি। বাবার সরকারি চাকরির কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় থেকেছি। কোনো নতুন পাড়ায় গেলেই এলাকার সব ছেলেকে নিয়ে ক্লাব থাকলে সেখানে যোগ দিতাম আর না থাকলে খেলাধুলার ক্লাব খুলে ফেলতাম। ময়মনসিংহে থাকতে ওখানকার সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে ফুটবল খেলার জন্য চালু করি ইস্ট বেঙ্গল বয়েজ ক্লাব। বাসার গ্যারেজের ওপরের রুমে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম ক্লাবের। ঢাকায় আসার পর ফুটবল ছাড়াও ক্রিকেটসহ অন্যান্য খেলার সঙ্গে পরিচিত হই। বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে বা আশপাশের মাঠে প্রায়ই খেলা দেখতে চলে যেতাম। ১৯৫৩ সালে সেন্ট গ্রেগরিজে ভর্তির পর খেলার তালিকায় যোগ হলো টেবিল টেনিস ও হ্যান্ডবল। সেই সময় খেলার স্কোরকার্ড, খেলোয়াড়দের ছবি কেটে কেটে সংগ্রহ করতাম।

আমি তরুণদের বলি, সব বিষয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে। শুধু আমি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ব বলে যে আমাকে শুধু বিজ্ঞানের বই পড়তে হবে, এ রকমটা নয়; বরং চারপাশের সব বিষয়ে জানতে হবে। একজন বিজ্ঞানীকে যেমন পরিবেশ নিয়ে জানতে হবে, তেমন পরিবেশের প্রতি মানুষের মনোভাবের ওপর ভরসা করেই বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। ভবিষ্যতের বিজ্ঞান হবে ন্যানো-টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি এবং কম্পিউটারের সংমিশ্রণে তৈরি এক উন্নত পৃথিবীর সংকল্পে ব্যবহৃত অংশ। যেখানে একজন বিজ্ঞানীকে সব বিষয় চিন্তা করেই বিজ্ঞান দিয়ে মানবকল্যাণে কাজ করতে হবে।

মস্তিষ্ক সজাগ রাখার চেষ্টা

আমি অনেক সময় গাড়ির নম্বর কিংবা যেকোনো সংখ্যা দেখলেই সেটার গুণক বের করার চেষ্টা করি। যদি গুণক না পাই, তাহলে সেটি একটি মৌলিক সংখ্যা। আর যদি গুণক পাই, তাহলে মনে মনে চিন্তা করে দুটি সংখ্যার বর্গের বিয়োগফল হিসেবে প্রকাশ করে ফেলি। এভাবেই মূলত যতটা পারি নিজের মস্তিষ্ককে সজাগ রাখার চেষ্টা করি।

বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ের প্রায় ১৩ বছরের ম্যাট্রিকে (এখন এসএসসি) সারা প্রদেশে যাঁরা প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন, তাঁদের নাম, স্কুলের নাম ও পরবর্তীকালে কোথায় পড়েছেন এবং কোথায় চাকরি করেছেন, তা আমি বলতে পারি। অনেক পুরোনো কিছু ঘটনার স্থান-কাল-পাত্রের কথা আমার মাথায় গেঁথে যায়। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের অনেক সহপাঠীর নাম তাদের রোল নম্বরসহ চেহারা মনে থাকে। অনেক সময় দেখা হলে আমি তাদের রোল নম্বর ধরে ডাকি। ওরা অবাক হয়ে যায়। কারণ, ওদের নিজেদেরই রোল নম্বর হয়তো মনে ছিল না। আমি বলে দিলে তখন তাদের মনে পড়ে। ঢাকা কলেজে আইএসসি ক্লাসে আমরা ২২১ জন ছিলাম। তার ভেতর ৫০-৬০ জনের রোল, নাম, তারা কে কোথায় কী করছে—সব মনে আছে আমার।

মনে রাখার জন্য বিশেষ কোনো অনুশীলন করি তা নয়। তবে ঘুমাতে গেলে যদি কখনো ঘুম না আসে, তাহলে সংখ্যা নিয়ে ভাবি, পুরোনো বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত মানুষের কথা ভাবি। বিভিন্ন লোকের মধ্যে আত্মীয়তা বের করার চেষ্টা করি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবেই দেখি। এত তথ্য আমাদের মস্তিষ্কে জমা থাকাটা আসলে ঠিক কি না। এতে অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ফলে মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে এটা মনে রাখা ভালো যে তথ্যটি কোথায় পাওয়া যাবে। তবে কিছু তথ্য মনে রাখাটাও জরুরি। শিক্ষাজীবনের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় মনে রাখা উচিত। আমরা ছোটবেলায় বিভিন্ন সংখ্যাভিত্তিক নামতা মুখস্থ করতাম। যার ফলে পরবর্তীকালে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান সহজে অল্প সময়ে করতে পারতাম। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই ধরনের নামতাগুলো তাদের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিলেও এখন আবার সেগুলো যোগ করা হচ্ছে।

আমার স্বপ্ন

২০০৪ সালে নটর ডেম কলেজে গণিত উৎসবের সমাপনী পর্বে আমি আমার তিনটি স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। প্রথম স্বপ্ন ছিল, ২০১০ সালের ভেতর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের কেউ পদক পাবে। যে স্বপ্ন আমরা অনেক আগেই পূরণ করেছি। গণিতে অবদান রাখার জন্য অনূর্ধ্ব–৪০ বয়সী ব্যক্তিকে কানাডার আন্তর্জাতিক গণিত ইউনিয়ন প্রতি চার বছর পর ‘ফিল্ডস মেডেল’ নামে একটি পদক দেয়, যাকে গণিতের নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন, ২০২২ সালের ভেতর কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তি এই মেডেল পাবেন। আর আমার তৃতীয় স্বপ্ন, ২০৩০ সালের ভেতরে কোনো একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় নোবেল পদক পাবেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমি আশা করি, তারা বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়ের (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন অথবা ফিজিওলজি/মেডিসিন) একটিতে নোবেল পুরস্কার লাভের মাধ্যমে এসব স্বপ্ন পূরণ করে আমাদের দেশকে উন্নতির এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।