কোথায় পাব পরবর্তী জে আর সি স্যার

জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার তাঁর সান্নিধ্যে আসা প্রত্যেকের জীবনকেই কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করে গেছেন। তাঁর সান্নিধ্য আসা সবারই আছে প্রিয় জে আর সি স্যারকে নিয়ে এমন কোনো গল্প। আমার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের অনেকের জীবন থেকে তেমন কিছু গল্প আজকে লিখছি।

অসংখ্য গুণে গুণান্বিত জে আর সি স্যারের ফটোগ্রাফিক মেমোরি ছিল অতুলনীয়। ছাত্র হিসেবে কৃতিত্ব অর্জনে এই গুণ তাঁকে সাহায্য করেছে। একই গুণের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান কাজের তালিকার কোনো কিছুই তিনি কখনো ভুলতেন না। অসংখ্য কাজের কথা মাথায় রেখেই তিনি নানাবিধ উদ্যোগ ও দেশের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক অনেক মেধাবী ব্যক্তিত্ব দেশের বাইরে যখন শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যই অর্জন করেছেন, তখন তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সাফল্যের উপাখ্যানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

যোগ্যতার কদর করতে পারার বৈশিষ্ট্য জে আর সি স্যারকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে তুলেছে সবচেয়ে বেশি। জে আর সি স্যার অসাধারণ মানুষদের দ্রুত চিহ্নিত করতে পারতেন, তাঁদের যথাযথ দায়িত্বে নিযুক্ত করতেন এবং সাফল্য অর্জনে তাঁদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশও নিশ্চিত করতেন। এরই ধারায় অন্যরা যেখানে শুধু কর্মপ্রতিষ্ঠানেরই উন্নতিসাধন করেছেন, তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এ ছাড়া ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের দায়িত্ব নিয়ে এই ইউনিভার্সিটিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে তিনি অবদান রেখে গেছেন। তাঁর সহায়তায় অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক কায়কোবাদের স্বপ্ন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। উপযুক্ত ব্যক্তিদের যথাযথ দায়িত্ব দিয়ে এবং সব ধরনের বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডকে দেশের একমাত্র বিশ্বমানের শিক্ষা-উদ্যোগে পরিণত করেছেন। তিনি দেশের আরেকটি স্বপ্ন পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নেও অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। সত্যি বলতে, সড়ক ও জনপথ থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন পর্যন্ত দেশের প্রায় সব বড় ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গেই তিনি যুক্ত ছিলেন। শিক্ষাবিদ বা সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সম্পদশালী ব্যবসায়ী পর্যন্ত দেশের সবাই তাঁকে সম্মান করতেন। যার ফলে, বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র হিসেবে তিনি যেকোনো শিল্পপতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। স্যারের কথায় তাঁরা আনন্দচিত্তে বুয়েটের যেকোনো স্নাতক ও অ্যালামনাই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তহবিল গঠনে সহায়তা করতেন। মূলত, জে আর সি স্যারের প্রভাবেই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থায়নে সংগঠিত পৃথিবীর একমাত্র গণিত অলিম্পিয়াড।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই আজকের অবস্থানে আসতে পারত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা সময় ছিল, যখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায়িক প্রশাসন বিভাগে পড়তেই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ছিল বেশি। আর কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ২০ জনের বেশি শিক্ষার্থীও ভর্তি হতো না। সে রকম একটা সময়ে তিনি একটি শক্তিশালী কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদ গঠনে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। আজ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে চার হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়ছেন। যে মেধাবীদের অন্যরা স্বীকৃতি দিতে চাইতেন না, তিনি তাঁদের নিজের ছায়ায় আশ্রয় দিতেন এবং রক্ষা করতেন। যেমন অত্যন্ত মেধাবী একজন অনুষদ সদস্য দেশের বাইরে থেকে ফেরত আসার পর এইচআর ডিপার্টমেন্ট তাঁকে এন্ট্রি লেভেল প্রভাষকের পদে নিযুক্ত করে। সেই সময় জে আর সি স্যার নিজ হস্তক্ষেপে ওই শিক্ষককে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের দায়িত্বে নিয়োগ করেন। আজ অবধি সেই শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। শুধু অসাধারণ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেই নয়; বরং অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ কূটনীতি থেকে বাঁচিয়ে তাঁদের কাজ কার্যকরভাবে সম্পন্ন করতে সহায়তা করার মাধ্যমেও জে আর সি স্যার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি ত্বরান্বিত করেছেন।

২০১০ সালে জেআরসি স্যারের চলে যাওয়া ছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে যাওয়ার আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির পথ বিনির্মাণ করে গেছেন। তাঁর নির্মিত ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে এমআইটি শিক্ষাপ্রাপ্ত ভিনসেন্ট চ্যাংকে উপাচার্য পদে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। তিনি জে আর সি স্যারের যোগ্য উত্তরসূরি এবং গুণগত মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জে আর সি স্যারের ধারাকেই অব্যাহত রেখেছেন।

জে আর সি স্যারের সঙ্গে আমার নিজের প্রথম সাক্ষাতের গল্প কিছুটা অন্যর কম। আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘মাহবুব, তোমার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’ আমি তখন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এক তরুণ যে কিছুতেই বিশ্বাস করত না, তার কেমব্রিজ, এমআইটি বা ইম্পিরিয়াল কলেজের মতো পরিবেশের প্রয়োজন আছে। তিনি আমার এ ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তবে তিনি কিছুটা হলেও সঠিক ছিলেন আর এখন মনে হয়, তাঁর মতামতকে হয়তো তখন আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল।

তবে আমার একগুঁয়েমির কারণেই তিনি আমাকে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো অনেক চিত্তাকর্ষক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করেন। তাঁর দৃষ্টিতে আমার বাংলাদেশে ফিরে আসার তরুণসুলভ সরল সিদ্ধান্তের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করতে তিনি এভাবেই আমাকে সাহায্য করেছেন। ফলে, একসঙ্গে আরও অনেকের সহায়তায় আমরা গড়ে তুলি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড, যা আজ পুরো দেশের অহংকার।

জে আর সি স্যারকে নিয়ে একেকজনের গল্প একেক রকম। তবে আমরা সবাই বুঝি, বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশে এমন আরও জেআরসি স্যার থাকার কথা। কিন্তু আশপাশে তাকালে তেমন কাউকে আমরা খুঁজে পাই না। অবশ্য এর কারণ এই যে জেআরসি স্যারের মতো যোগ্য মানুষেরা বহু আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মতো দেশ গড়ে তুলতে নিজেদের মেধা কাজে লাগাচ্ছেন। জে আর সি স্যার ছিলেন অন্য রকম। তিনি দেশেই থেকে গেছেন; এমনকি ১৯৭১-এ যখন তাঁর সহকর্মীরা দেশ থেকে চলে গেছেন, তখনো তিনি দেশেই ছিলেন। এরপর তিনি দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন; তিনি বাংলাদেশকে গড়ে তোলেন। তাই তো, জে আর সি স্যারের বিদায় এতটা বেদনাদায়ক। কোথায় পাব আমরা আমাদের পরবর্তী জে আর সি স্যারদের; যাঁরা ত্যাগ স্বীকার করে, দেশে থেকে গিয়ে, নিজেদের মেধা ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশ নয়, বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন?

লেখক: অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার: চেয়ারপারসন, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং; ডিন, স্কুল অব সায়েন্সেস, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। কোচ, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড।

ভাষান্তর: ঈপ্সিতা বহ্নি উপমা